জপমালা ঘোষ রায়



সকল শূন্য করে

জপমালা ঘোষ রায়


দীপঙ্কর দত্তের সঙ্গে আমার ভারচুয়াল বৌদ্ধিক বন্ধুত্ব মাত্র তিন বছরের। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে কলকাতা বইমেলায় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়েছিল। তার আগে পোস্টমর্ডান ব্রুহহা ব্যাপারটা খুব নতুন মনে হয়েছিল। পড়ার সুযোগ পাই নি। তীব্র আগ্রহও ছিল না পড়ার। কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকায় দু একটা কবিতা পড়েছিলাম,যা আমার নিম্নমেধাকে তেমন করে ছুঁতেও পারে নি। ২০০৭ সালে আমাদের আয়োজিত কাটোয়া লিটলম্যাগাজিন মেলায় এসেছিলেন দিলীপ ফৌজদার মহাশয় এবং দীপঙ্কর দত্ত। আলাপ হয়েছিল দু একটা সংলাপ। ব্যস ওই পর্যন্ত। শুধু অবাক করেছিল একটা বিষয় যে বাংলার প্রত্যন্ত  প্রান্তিকে দুজন বহির্বঙ্গীয় মানুষ হাজার মাইল  ছুটে এসেছেন শুধুমাত্র কবিতা আর লিটলম্যাগাজিনের টানে। তারপর ভুলে গেছিলাম দীপঙ্কর কে। দিলীপদাকে মনে ছিল। মাঝেমধ্যে  কবিতা পাঠিয়েছি দিল্লী হাটার্সে। কবির  অন্তর্প্রেরণার সঙ্গে সবসময়ই জুড়ে থাকে তাঁর সমকাল, সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সেই সঙ্গে অবশ্যই আমি মনে করি তাঁর স্থানিক প্রেক্ষিত। এরপরের আনুষঙ্গিক হল ধর্ম পরম্পরা শিক্ষা ইত্যাদি। একজন কবির মৃত্যুর পর তাঁর কবিতা ছেড়ে দিয়ে বিগত জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করা অনর্থক কেননা কবি কোন সন্ত নন যে তাঁর  মত পথ ও আদর্শের অনুগামী  হতেই হবে। আমরা বরং কেউ কেউ তাঁর কবিতার ফ্যান হতে পারি।  আবার নাও পারি।  না হলেও ক্ষতি নেই কিন্তু কবির মৃত্যুর পর তাঁর কবিতাগুলো যতদূরসম্ভব পাঠকের মধ্যে, দরকার হলে ন্যূনতম বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে দেওয়াই সমীচীন। মৃত্যুর পর স্বাভাবিক আবেগজনিত কারণেই স্মৃতিচারণা একধরণের মোহের জন্ম দেয় যা কবিকে সঠিকভাবে চিনে নিতে দেয় না। কবির ওপর অন্ধ মোহের ভুসোকালি পড়ে। কবি কখনওই  জীবনের বিষামৃতের ঊর্ধ্বে নয়। দীপঙ্কর দত্তও ছিলেন না। যতটুকু জেনেছি, তিনি একজন পালিশ না করা আকরিক মানুষ ছিলেন এবং তিনিও এ মোহের আবরণ  খুলেই দাঁড়াতে চেয়েছেন জীবনে এবং কবিতায়। লেখার মত মানসিক অবস্থায় ছিলাম না। কিছুতেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না বলে লিখবো না ই ভেবেছিলাম।  কিন্তু শূন্যকাল এর ভারপ্রাপ্ত  সম্পাদক ভ্রাতৃপ্রতিম পীযূষ বিশ্বাসের বারংবার  সনির্বন্ধ অনুরোধে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণই করলাম, যেহেতু এই সংখ্যাটি তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যেই।

   # দীপঙ্করের কাজ কর্ম নিয়ে আলোচনা হত ফেসবুক ইনবক্সে, মেইল এ, কখনো সরাসরি ফোনে। বাংলা কবিতার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ। অনেক মানুষের সঙ্গেই তাঁর দূরালাপী বন্ধুত্ব ছিল। এই আলোচনা থেকেই জেনেছিলাম তাঁর শিকড় প্রোথিত ছিল অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল। তাঁর মাতৃভাষা ছিল বরিশালের আঞ্চলিক বঙ্গালী উপভাষা। জীবনস্রোতে ভাসতে ভাসতে তিনি প্রথমে কলকাতা এবং তারপর দিল্লীবাসী হন। যত আলাপ হয়েছে আমি অবাক হয়েছি তাঁর ব্যাপ্তি দেখে। ভারতীয় পুরাণ, পরম্পরা, হিন্দু মন্ত্র, ঋকমন্ত্র, জ্যোতিষ শাস্ত্র, আয়ুর্বেদিক ওষুধ পত্র, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, এমন কি রান্নাবান্নাও জানতেন।  সব তাঁর মুখেই আমার শোনা। তাঁর কাজ আমাকে বলে যাওয়া আমার কাজ বাধ্য ছাত্রীর মত কোন রকম তর্কবিতর্ক না করে শুনে যাওয়া। হয়ত আমার এই শুনে যাওয়ার ধৈর্য তাঁর বলে যাওয়ার অনুকূল ছিল। হয়ত বলার অনেক কথা ছিল। হয়ত আপাত কাঠিন্যের আড়ালে সহজতা লুকানো ছিল। তিনি বলেছিলেন প্রকৃতি বলতে তাঁর জন্মভূমি যা আর তাঁর নেই। তিনি কংক্রিটের জঙ্গলে পুনর্বাসিত। কাজেই তাঁর কবিতার প্রকৃতি অন্য। তিনি বলেছিলেন ব্যক্তিগত জীবনের নানা অশান্তি ও উত্থানপতনের কথা, এভাবেই----- "কভি তকদির কা মাতন কভি জিন্দেগী কা গিলা" আর কিছু বলতে হয় নি। খুঁজে পাওয়া গেছিল তাঁর কবিতায় জীবনের পাজল এবং পার্টিকল। সম্পাদিত ওয়েব ম্যাগাজিন শূন্যকাল কে এভাবে ব্রোকেন ইমেজ, বিভৎসতা ভঙ্গুরতা ইত্যাদি দিয়ে অলংকৃত করে তোলা থেকেই তাঁর কাব্যপ্রেরণা, প্রবণতা তাঁর জীবন দর্শন বোঝার চেষ্টা  করেছি। "দীপঙ্কর দত্তের কবিতা" কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলো আগে পড়েছিলাম। তারপর মৃত্যুর পর পড়ছি "ব্রেইলবর্ণ বিষহরি"। ব্রুহাহা কী আপনারা জানেন।  শব্দটির উৎপত্তি ক্রমবিকাশও জানেন। যে কবির ব্যক্তিজীবনে বারবার স্থানচ্যুতি, স্থানান্তরণ ঘটে, বারবার শিকড় উপড়ে যায় আর তিনি নিজস্ব ইতিবাচক অন্তর্প্রেরণা থেকে পরিবর্তিত স্থানে নিজেকে উপস্থাপিত  করেন, সংস্থাপিত করেন তিনিই তো স্বয়ং ব্রুহাহা, ভ্রাম্যমাণ ভুখন্ড। তাঁর কবিতার প্রকরণে খুব স্বাভাবিক কারণেই এসেছে বিকেন্দ্রিত ভাবনা চেতনা এবং অবশ্যই উপযোগী শব্দ ও ডায়াস্পোরিক ভাষাসংকর। ডায়াস্পোরা কী,এই সাহিত্য আন্দোলনের জন্ম ও কর্মভূমি এবং সংজ্ঞা ও বিস্তার আপনারা জানেন। এখানে সে আলোচনা নিষ্পপ্রয়োজন। তাঁর কবিতার ভাষাকে শিক্ষকমহাশয়গণ ঔপনিবেশিক বলতে পারেন। কিন্তু আমার সীমিত জ্ঞানে যে সব বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে  সেগুলো নিয়ে অন্যসময় বলার চেষ্টা করব।

    # এইসব  বৌদ্ধিক দূরালাপ থেকে কখন যেন তিনি ছুঁয়ে ফেলেছিলেন আমার ব্যক্তিগত যাপন। অনেক সাংসারিক কথাবার্তাই হত দীপঙ্করের সঙ্গে। অনেক উপদশে ও নির্দেশে ঋণী করে গেছেন আমাকে। আমার ব্যস্ততা এবং অসুস্থতার কারণে নিজের আগ্রহেই আমার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ সংকলনের প্রাথমিক কাজগুলো করে আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। শেষের দিকে আমার স্বামী মেয়েসহ পরিবার পরিজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আমার শহরে আবার আসতে চেয়েছিলেন।  সে আর হল না।  আসার আগেই চলে গেলেন বন্ধু দীপঙ্কর।  রেখে গেলেন তাঁর জন্য কিছুই না করতে পারার আফসোস। 

1 comment:

Facebook Comments