স্বপন রায়


 

দীপ্র প্রতিভা দীপঙ্কর 


স্বপন রায়


#
কবি দীপঙ্কর দত্ত প্রয়াত। আমার চেয়ে বয়সে ছোট দীপঙ্করের সঙ্গে আমার ছিল পারপ্সপরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক।আমার তরফে দীপঙ্কর আর ওর কবিতা শ্রদ্ধেয় ছিল একটি মাত্র কারণে যে, দীপঙ্করের কবিতা আমার অগম্য ছিলনা, কিন্তু কবিতাভাষা ছিল!আমি কখনোই, এমনকি নকল ক’রলেও ওর কবিতাভাষার ত্রিসীমানায় যেতে পারবোনা!

#
দীপঙ্কর জীবন আর সময় এই দুটোর সমীকরণে কিছু সাধনাতীত মদ মিশিয়ে দিয়েছিল।একদিকে ওর অসামান্য অধীত বিদ্যার ভাণ্ডার অন্যদিকে অধিবিদ্যার সাধনা দীপঙ্করকে আলাদা ক’রে তুলেছিল সবার থেকেই।এই জীবনের আহৃত নেশা আর তার অবিমিশ্র প্রভাব দীপঙ্করের ব্যক্তিজীবন আর কবিতাজীবনের ফারাকটি মুছে দিয়েছিল ক্রমশই।এই তার সততা। তার আমৃত্যু আপোষহীন সততা।

#
দীপঙ্কর কবিতাকে বিস্তৃত করেছে জীবনের এমন তরঙ্গক্ষুদ্ধতায় যা বাংলা কবিতার ধাতে ছিলনা। হাংরিউত্তর মুন্সিয়ানা যেমন ছিল তেমনই ছিল বিষয়ের চূর্ণ আক্রোশ, যেন সে আক্রমণ করেছে এটা জেনেই যে তার কোন সুরক্ষা নেই, আত্মপক্ষ নেই।

#
দীপঙ্কর লিখছেঃ
‘কেউ হীরা চাটে ফলিডল খায় অ্যাসল্টের আগে তুমি সেই কোন কালে
সাইজ্যা বইয়া আছো ছিন্নমুণ্ডা !
ক্রোশ ক্রোশ ফুটিফাটা সমুন্দরের এ প্রান্তের
তুমি মোরে অকরুণ করেছো মিশ্র পিলু সরহদি গাঁও..’(কবন্ধ)
প্রতিটি পংক্তি কি ভাষায়, কি গঠনে বা উচ্চারণে এবং বিষয়ান্তরে আলাদা।সাধু, চলিত, হিন্দি, সঙ্গীত, আর আধ্যাত্মিকতা এভাবে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু দীপঙ্কর এটা পারতো।দীপঙ্করই এটা পারতো।ভাষাকে শুধু ‘টুল’ হিসেবে ব্যবহার না করে তার উচ্চ আর নিম্নসীমাকে ক্রমাগত আঘাত করে গেছে ও।সাহস আর উদাসীনতা ছাড়া যা কিছুতেই সম্ভব নয়।

#
কবিতার চৌহদ্দি ব’লে কিছু হয়না যেমন ঠিক, সেরকমই ওই চৌহদ্দি ভাঙতে না পারলে থেকে যায় পদ্য হয়ে, কবিতার গল্প হয়ে। ভাষা স্থবির হয়, তাতে কি যায় আসে ধারাকবিতার?দীপঙ্কর এই জায়গায় বিস্ফোরক আঘাত করেছে।আর এর জন্য কোন আন্দোলিত কবিতার ইশতেহার বের করেনি।যা করেছে ওর প্রতিস্পর্ধী লেখায় করেছে। ধারাবাংলার উচ্চারণের বাইরে গিয়ে এক মেট্রোচকিত কর্পোরেটোৎসারিত তন্ত্রজাত তোয়াক্কাহীন ধুন্ধুমার ভাষায় দীপঙ্কর ওর কবিতা লিখেছেঃ

‘যেন বেউলা, মালসায় বুলেট গলছে খোন্তার আধো আধো ঠোনায়
আর ক্ষুধা বিষ-ফোঁড় নকশি টনটন করছে তোর আমার
ঘ্যাগ গোদ কুঁজের সোরাইসিস শল্কের পরত -
একেকটা দিন আসে ভাতেরা চূড়াধারী
কাচকি বাটি চড়চড়ির রত্তি টপিংয়ের গরাস মুখে ধরে থমকে
ভাত শুকোয়ে চাল আমরা একে অপরকে অপলক দেখি 
পায়ে-বেড়ি শূদ্রানীর নিধি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া
ঘর ফেঁড়ে ফেঁড়ে উনোনে গুঁজে দেওয়া দরমা ও খড়
এখন ক্রমে নিভতে নিভতে
ধোঁয়াতে ধোঁয়াতে
ছাই চাপা ঠান্ডা ঘোলাটে চোখগুলি চেয়ে থাকে
একুনে একত্তিশ কাহন চার পণে কেনা পুঁয়ে পাওয়া শিশুটির দিকে...’ (অর্বুদ )
পুরো কবিটাতাই তুলে দিলাম। নইলে দীপঙ্করের অনির্বচনীয় বিমর্ষউল্লাস, ওর নেতিওগালানো অনুভবের সারাৎসার অধরা থেকে যাবে।নম্রতার শিঙাফোঁকা বিষফোঁড় নকশা ওর শব্দে দামামা তুলে দেয়।আর ও লিখে ফেলেঃ
‘কাচকি বাটি চড়চড়ির রত্তি টপিংয়ের গরাস মুখে ধরে থমকে
ভাত শুকোয়ে চাল আমরা একে অপরকে অপলক দেখি..’

#
প্রচলিত নান্দনিকতার ধার ধারতোনা দীপঙ্কর।কারণ ওর দেখায় স্থাপিত কোন অবয়ব ছিলনা। প্রতিমা ছিলনা।ও অনায়াসেই লিখতে পারতোঃ
১. বৌ তোর আউশের খেতে পা-ফাঁক যতো কোঁথ ততো কাঁথায় পাঁজাকোলা আলো
ছাতিমের নাতিন হলে সুয্যিটিও ক্রোশ ক্রোশ শলাকা গুটিয়ে কেন্নো নিভে আসে —(প্রাকৃত)
২. ঘণ্টা-দুঘণ্টার একেকটা ফুলটু বৃষ্টি হয়,
সিগনিদের ফায়ারওয়ার্কস থেমে আসে,
আমরা ভাবি দারু ও দ্রুমের ওপিঠে সানি সাইড আপ,
ধনু ধনু শাল্মলী সিঁথি ও বিশালাক্ষীর ওপরে দিবানগি চিথরে উড়ে আসে
আলোভরা জেল ;(খাণ্ডব)
৩. রাজমা ও কিডনির কলামকারি একেকটি গ্লোমেরুলাসের শর্ট সার্কিট চিবোতে
আমাদের কোনো কেচাপ লাগে না
রাত্রি তিনটেয় ফ্লাডগেট ভেঙে আগুনের অনর্গল দাউ আর লপেট কাম্ অন্
আগে চুল খুলে একবার হেঁটে দেখাও দিকি মা
রোবীন্দ্রোশোঙ্গীৎফোঙ্গীৎ পরে হবে খন —(খাণ্ডব)
৪. কেষ্টর ক্লথ মিলে তালা, দুঃশাসনের হ্যাঁচকা পাক খেয়ে খেয়ে ল্যাংঠা
লোমে সাপরক্তের রগুড়ে বেহতরীন সে বেহতরীন ফ্যানা ফ্যানা শ্যাম্পু মজিলো
আকখা সোনাগাজি তাকরেলা বাপ ছানের জল ঢাল ভাড়ু
যে কোঠায় যাবি বিছনায় শিঠানো পোলকা ডট চোইদ্দর নিচে
ছেলিয়া চোষে নাই বেজিমা'র মাই-শিরার ফিরতি দুধের রঙ বিষ-নীলচা
নির্জীব পেল পিঙ্গল এখন ইফতারে কম সে কম ভুখারে মুখে চুক্কি গেরাস তো ধর
না হাসে তো আস্তিনের সাপছাওয়ালেরে রগড়া দুদুভাতু
চামসার খ্যাঁচায় টিকলিং ম্যাও ম্যাও কাতুকুতুকুতুকুতুকুতুকুতু — ( ব্রেইলবর্ণ বিষহরি)

#
নান্দনিকতা খুঁজে বেড়ানো পণ্ডিতের কাজ। কবি নান্দনিকতা তৈরি করে। পণ্ডিত চিহ্ণিত করে। দীপঙ্করের কবিতা নতুন নান্দনিকতার কবিতা। আর একারণেই আমার ভাল লাগত দীপঙ্করকে। আমি জানতাম যে আমরা দুজনে আলাদা রাস্তায় হাঁটছি, সহযাত্রী আমরা নই। সহধর্মী অবশ্যই।আজ দীপঙ্কর নেই। ওর এমন অবঙ্গজ বাংলায় বিদ্ধ হয়ে আছি আমি।থেকে যাবো আমৃত্যু।
(কবিতাগুলি শূন্যকাল ওয়েবজিন থেকে সংগৃহীত)         
  

2 comments:

  1. choto crisp sharp biNdhe jabar moto alOchona, r brailborno bishhorir j kota jayga uttapon korle, segulor moddhe priyo besh kota line pelam... oshadharon...

    ReplyDelete
  2. অত্যন্ত প্রাণবন্ত একটা স্মার্ট আলোচনা । কম কথায় অনেক সমৃদ্ধ রচনা । কবিতার আলোচনা খুব দৃঢ় ও স্বচ্ছ । "অর্বুদ" কবিতায় কবি দীপঙ্কর দত্ত লিখেছিলেন ---
    "আমার মায়েদের দিকে চিংড়ি মাছের বাটি চচ্চড়ি বানিয়ে সাদা ভাতে একটু ঘি মেখে অল্প অল্প বাটি চচ্চড়ি সাদা ভাতের ওপর রেখে সেই গ্রাস মুখে ঢোকানোর একটা স্টাইল দেখেছি। এখানে নারী-পুরুষের ভাত খাওয়ার দৃশ্যে সেটা ঢুকিয়েছি। কাঁচকি মাছ।"

    আর 'প্রাকৃত'কবিতার প্রসঙ্গে বলেছিলেন
    12/29/2016 12:52PM
    "আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র অনুসারে কোনো শূদ্র নারী যদি ব্রাহ্মণ পুরুষের সঙ্গে গমন করে তো তাকে ৩১ কাহন ৪ পণ জরিমানা দিতে হতো। মুসলিম অধ্যুষিত ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় হিন্দুরাও "মালাউন" বা কাফের বিশেষ। শূদ্র-শূদ্রানী এখানে প্রতীক। এদেশে কোনো জরিমানার বিনিময়ে শান্তি কেনা যাবে না।"
    আপনার লেখা পড়ে মনে পড়ে গেলো সে সব আলোচনা ।

    ReplyDelete

Facebook Comments