দিলীপ ফৌজদার



দীপঙ্কর ও কবিতা

দিলীপ ফৌজদার


দীপঙ্কর সম্পর্কে সে গত হওয়ার পরবর্তীকার এই লেখাটার নাম ‘দীপঙ্কর ও কবিতা’ই রাখলাম। এখন তো সে নেই। এই জায়গাটায় এসে এখন স্পষ্টই দেখছি যে কবিতা ছাড়া আর কোন কিছুর সঙ্গেই দীপঙ্করের প্রকৃত প্রেম বলতে গেলে ছিলই না। কবিতা ছাড়া আর কোন কিছুর সঙ্গেই সে একনাগাড়ে এবং পরিপূর্ণভাবে জুড়ে ছিল না। কিন্তু কবিতা তো আর একা একা হয় না তাই আসে বন্ধুবান্ধব, আড্ডা ও আনুসঙ্গিক আর যা যা কিছু। অনেকে অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্ন মত রাখেন যে কবিতা তো প্রকৃতপক্ষে একা একারই বিষয়, যেটা মেনে না নেওয়ারও তেমন আঁটোসাঁটো কোন তর্ক নেই। দীপঙ্করও নিজের কবিতা একা একাই লিখত। এত সব কিছু মেনে এগোলেও এখানে সম্পর্কটিকে একটা বিশেষ শ্রেণিতে ফেলতে বাধ্যই হতে হয় বলতে গেলে, কারণ, দীপঙ্কর ও কবিতার মধ্যেকার প্রেম খুবই দৃশ্যমান একটা ব্যাপার ছিল। 

দীপঙ্করের বন্ধুত্ব যাদের সঙ্গে তাদেরও কবিতার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া মোটামুটি জরুরীই ছিল দীপঙ্করের জন্য। এর পরবর্তীকার দীপঙ্করের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার এসেন্সিয়্যাল কোয়ালিফিকেশন ছিল যে তাকে ভাল কবি হতে হবে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি ভাল কবি বলে তো কিছু হয় না জগতে। যা হয় তা হল পছন্দের কবি বা অপছন্দের কবি। এ প্রসঙ্গে দীপঙ্কররের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা শুধু যে একটা বিশেষ তন্ত্রে বাঁধা থাকত তাই নয়, পছন্দ-অপছন্দটা যথেষ্ট প্রবলও ছিল। এসব নিয়ে ছেলেমানুষিও ছিল। ব্যক্তিগত সম্পর্কের হেরফেরে কখনো কখনো পছন্দের কবি অপছন্দের হয়ে যেত, আবার কখনো বা অপছন্দের কবিও পছন্দের দলে চলে আসত। 

১০ই জানুয়ারি ২০১৭। বিগত এই কয়েক মাসের অন্যান্য দিনগুলির মতই আমার দিন কাটছিল শিথিল, সংসার বেশি সময় দাবী করে অথচ বাইরে বেরোতেই হয় এমন একটা অবস্থা। অলোক বিশ্বাসের ফোন এলো একটা, কদিন ধরেই আসছিল, কেন আসছিল এখন বেধড়ক ভুলে গেছি পরবর্তী ওলটপালোটে যার শুরুয়াতই ছিল অলকের ঐ ফোন। ‘তুমি এক্ষুণি দীপঙ্করের ফোন নাম্বারে কল করো্’। ফোনটা কেটে গেল। লাইনটা জুড়তে গিয়ে দেখি হিমাদ্রি দত্ত ফোন করেছিল। সাড়া পায়নি। ভাবলাম আগে দেখে নিই হিমাদ্রি কি বলতে চাচ্ছে – দীপঙ্কর তো কলকাতায়, ওকে ফোন মানে সময় নেবে। হিমাদ্রিকে ফোন করতে ও বলে উঠল ‘দীপঙ্করের খবর জানো! দীপঙ্কর তো মারা গেছে। আজই সকালে ওর প্রতিবেশিরা ওর ফোন থেকে আমার নাম্বারে জানিয়েছে’। দীপঙ্করের পুরো মানচিত্রটা আমার মাথার ভেতরে তখন খেলা করছে, জ্বালাচ্ছে, চিনচিন করছে, দপদপ করছে। অবিশ্বাস করার কোন কারণই ছিল না। দীপঙ্করের ব্লাডশুগার জনিত সমস্যা রয়েছে প্রকট, যদিও সে এ ব্যাপারে খুব সাবধানী, তাও, একা থাকে এবং সময়ে সময়ে ওর মদ্যপান মাত্রার অনেক ওপরে চলে যায়। 

তার মানে দীপঙ্কর কলকাতা যায়নি! ওর কবিতার বই বেরোনর কথা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় যার প্রতিটি কবিতাই নতুন লেখা। তার প্রকাশিত এর আগের দু তিনটি কবিতাগ্রন্থে- নির্বাচিত পোস্টমডার্ণ (২০০৪), জিরো আওয়ার পাওয়ার পোয়েট্রি (২০০৬), দীপঙ্কর দত্তর কবিতা (২০০৭) ছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আগের লেখাগুলির পুনরাবর্তনের সঙ্গে বিরল কটি নতুন লেখা ‘দিল্লী হাটার্স’, হয়তো বা ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ এবং এছাড়া ওর নিজের ইস্তাহারগুলিতে প্রকাশিত। ইস্তাহার কথাটা ব্যবহার করলাম কাগজগুলির সংক্ষিপ্ত, মতামতবহুল অথচ প্রসারিত চেহারার কারণে। এগুলির মারফৎ দীপঙ্কর কবিতা সম্পর্কিত তার নিজস্ব ধারণাবোধ জনসমক্ষে রাখত।  দীপঙ্কর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত বা সকলকে এই মতে টানার চেষ্টাও ছিল তার প্রবল যে কবিতার জন্যও আন্দোলন হয় যা দিয়ে কবিতার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া যায়। তার ইদানিংকালের, মানে গত এক বছরে কোথায় কি হয়েছে আমার জানা নেই। এতটা জানি যে আপনজনদের কারো সঙ্গেই কোন সম্পর্ক সে রাখে নি। যে বন্ধুরা ওর কাছাকাছি বলে সবাই মনে করত তাদের স্নেহ ভালবাসারও সে কোনদিন কোন দাম দেয় নি। যে কোন ব্যাপারে সে প্রকাশনার কথাই হোক বা আড্ডা কিম্বা সমবেত খাওয়াদাওয়া, অথবা পাব-রেস্টুরেন্ট, খুব জোরালো একটা দাবী রাখত যেটির ধকল সামলাতো অন্য কেউ কিন্তু সেটির পালন হতে হবে দীপঙ্করেরই সোচ্চার নির্দেশে, পুরোপুরি তার সর্তে। একটু য়ুটোপিয়ান ব্যাপারস্যাপার ছিল যেগুলো সামলানো হোত সকলে মিলেই তবে আমরাও কিছু ফ্যানটাসি বা উদ্ভটরসের আনন্দ তো পেতামই। তা না হলে সে কেন এত আদৃত ছিল কিছু মানুষের কাছে? আমার এটাও মনে হয়েছে যে করিশ্মাটা ছিল তার দেহ ও কথিত ভাষার সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি যেটা ছিল নিখাদ ভালবাসার, সে ভালবাসা কবিতার প্রতি হলেও বন্ধুমহল সেটাকে সামাজিক অন্তরঙ্গতাই ভেবে নিত। এইখানে চরিত্রটি স্পষ্ট নয় যেটা কবিতার ব্যাপারেও। কবিতা নিয়ে মনে হোত ওর বেশি ভাবনা, বেশি concern ছিল শব্দচয়ন ও সেগুলির সাজগোজ নিয়ে, যেমন, আগেই শব্দগুলো এসে যেত ওর মাথায় সেগুলি সে লিখে  রাখত ও তারপরেই সে পোস্টমডার্ণিজমের ফর্ম্যাটে সেটাকে compose করে কবিতাটি নির্মাণ করে নিত। এটা সেই কথা দিয়ে কথা বলাই, কিন্তু কি এক আশ্চর্য উপায়ে সে এই শব্দজটের ওপর synergy effect এনে সেটিকে কবিতায় পর্যবসিত করত সে এক যাদুমায়ার রসায়ন – যাঁরা দীপঙ্করের ‘আগ্নেয় বসন্তের জাগলার (১৯৯৪)’ এবং ‘ব্রেক টু গেইন এ্যাকসেস’ (২০০১) এই দুটি কবিতাসংগ্রহ পড়েছেন তাঁরা আমার কথা বুঝবেন। 

‘যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে তারা কথার মালা গাঁথে’

ছিল হয়ত দীপঙ্করের চরিত্রে কোন আধ্যাত্মিক কামরা যেটা সময় হলে ফুটে উঠতে পারত হয়ত বা। হ্যাঁ, দীপঙ্কর সর্বত্রই, সব পরিস্থিতিতেই, কথা দিয়ে কথার মায়াময় মালাই গাঁথত। কিন্ত সে কথাগুলির সঙ্গে দীপঙ্করের ব্যক্তিসত্ত্বার কতটুকু সম্পর্ক ছিল? আদৌ কি ছিল? অনেককেই তো বলতে শুনি দুটো দীপঙ্কর ছিল। অনেকে আবার এটাও বলেছেন দীপঙ্কর কবিতা তো নিজের জন্যই লেখে, সে কবিতাকে তো ধরা যায় না। দীপঙ্করের নিজস্ব কাগজ ছিল – ‘জিরো আওয়ার’, আষ্ঠেপৃষ্ঠে তার সিগনেচার বসানো। কাগজটার মলাটে লেখা থাকত “স্থা বিরোধী………”। যেহেতু কাগজটা যখন হাতে আসে তখন পুরো ব্যাপারটাই আয়ত্ত্বের বাইরে ছিল তাই “স্থা” দিকটা চিন্তা প্রণালীর বাইরেই থেকে গেছিল তখনো। দীপঙ্করের সঙ্গে বেশ কিছু বছর একসঙ্গে কাটানর পর কলকাতায় কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসে কেউ একজন আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল দিল্লিতে কয়েকজন মিলে কবিতায় ‘স্থা’ বিরোধী আন্দোলন করে – তাদের একটা পত্রিকাও আছে। আমি একটু অবাকই হলাম। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর বুঝলাম ঐ রাডিক্যাল আন্দোলনকারীটা হোল দীপঙ্কর দত্ত, আর পত্রিকাটা ‘জিরো আওয়ার’। দীপঙ্করের সঙ্গে ততদিনে কবিতা নিয়ে কবিতার আন্দোলন নিয়ে পোস্টমডার্ণিজম নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমার মনে এই ধারণা বেশ জমে বসেছে্ যে বাংলা কবিতা এবং কবিতার কলকাতা পরিমণ্ডল সম্পর্কে দীপঙ্কর যথেষ্টভাবে ওয়াকিবহাল থাকলেও ওর কবিতা-ধারণাগুলি মোটামুটি স্পষ্টভাবেই ছিল একটেরে ও জেদী। মনে হোত ও ধারণাগুলি তুলে এনেছে প্রকাশিত কোন তথ্যভাণ্ডার থেকে খুব সম্ভবত বাংলা লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে প্রকাশিত নিবন্ধাবলী এবং আশি দশকের কিছু সমসাময়িক ইংরাজী রচনা থেকেও কিন্তু কলকাতাস্থিত কোন গুরুর কাছ থেকে নয়। মলয় রায়চৌধুরি দীপঙ্করের যে ইন্টারভিউটা নিয়েছিলেন - যেটা দীপঙ্করের প্রসঙ্গে বহুচর্চিত – সেটা তার বাংলা কবিতার আখাড়ায় জাঁকিয়ে বসে পড়ার পরবর্তী ঘটনা। এ ঘটনার পরে অবশ্য মলয় দীপঙ্কররের আরাধ্য গুরু হয়ে বসেছিলেন। ‘পোস্টমডার্ণ’ সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরি যা মতামত রাখতেন দীপঙ্কর সেগুলিকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিল। ‘জিরো আওয়ার’ ছাড়াও সে ‘অ্যাসাইলাম’ নামে কবিতার একটা কাগজ করছিল যেটা সম্ভবত ‘জিরো আওয়ার’ এরই বিকল্প ছিল কেননা ততদিনে ‘জিরো আওয়ার’ এর ক্ষুদে সঙ্ঘ ভেঙে গেছিল – দীপঙ্কর বুঝতে চায় নি বা মেনে নিতে চায় নি বা ধরেও বসেনি যে সেটা ‘স্থা’ বিরোধীতারই একটা স্বাভাবিক ফলশ্রুতি ছিল। ‘অ্যাসাইলাম’ও ছিল ঐ কয়েক পাতারই, বড় জোর আট, এ-ফোর সাইজের হয়ত বা আড়ে দীঘে দুদিকেই একটু একটু বড়োসড়ো কিম্বা ওটা আমার কল্পনা। ওগুলো এমনিতেই নিজের সাইজের থেকে একটু বড়ই ছিল সবসময় পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন কবিতাপত্র ই্ত্যাদি সম্পর্কে দীপঙ্কর ভাবত সেগুলোর সক্কলেই হবে ‘জিরো আওয়ার’ এরই মতো। যে কারণে দীপঙ্কর ‘দিল্লি হাটার্স’ অপছন্দ করত। ‘দিল্লি হাটার্স’এ কবিতা ছাড়া অন্য কিছু, যেমন, গল্প বা কবিতা বিষয়ের বাইরেকার অন্য কোন প্রবন্ধ-নিবন্ধ বা নিতান্তই সংবাদমূলক লেখালেখি থাকলে সেটা তার প্রবল মহাবলী সমালোচনার কবলে পড়ত যেটা অনেক সময় সহ্যের বাইরে চলে যেত। সে আবার এটাও চাইত, সেটাও সেই প্রবলভাবেই যে, ‘দিল্লি হাটার্স’এ সাড়া জাগানো, উত্তেজক, বিতর্কিত, ব্যাপারগুলি আসুক। ‘দিল্লি হাটার্স’ যেহেতু বাংলা সাহিত্য বাজারের সংবাদপত্র হয়ে দাঁড়ানর যোগ্যতা রাখত না আমাদের এই প্রয়াসটি ওদিকে বেশি এগোতে পারে নি। তার ধারণা ছিল, যা তার মন্তব্যেও থাকত যে ওগুলি না থাকার কারণে কাগজটাকে এমন ম্যাড়মেড়ে, স্বাদহীন মনে হয়। আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে দীপঙ্করের ধারণায় তফাৎ ছিল শুধু ডিগ্রিতে। জোর করে কিছু হওয়ানয় বা করায় আমি বিশ্বাস রাখি না। কবিতা প্রসঙ্গে এক্সপেরিমেন্ট কথাটা দীপঙ্করের পছন্দসই ছিল। এক্সপেরিমেন্ট বলতে আমি তো বুঝি – করে দেখা - সে হিসেবে প্রতিটি কবিতাই তো এক্সপেরিমেন্ট। দীপঙ্করের কবিতা ধারণার সঙ্গে আমার কবিতা ধারণার আরেকটা গরমিল এই ছিল যে কবিতার সঙ্গে হাল্লাবাজিকে জুড়ে দিতে আমি অপারগ ছিলাম।  তাছাড়াও, হাল্লাবাজী করতে গেলে তো লোকজন লাগে, টাকা লাগে। আমার এখনো ধারণা কবিতার সঙ্গে নীরবতার যোগ আছে এবং কবিতা সৃষ্টি এবং তার নির্মাণ কবির একার জিনিস হলেও কবি সম্পর্কহীন ভাবে সেটা করতে পারেন না। কবিতা সাহিত্যও। মানুষের সঙ্গে জুড়ে থাকা কবিতার মৌলিক ধর্ম। বিচ্ছিন্নতা কবিতার কাম্যবস্ত নয়। 

দীপঙ্কর নিজেও অনেক সময় বলেছে ‘আমার, আপনার, গৌতমদার, অরূপদার আমাদের বই লোকে পয়সা দিয়ে কিনবে কেন? ‘দিল্লী হাটার্স’ই বা কেন কিনবে? আমাদেরই সকলকে দিয়ে বেড়াতে হবে’। আমি বলতাম ‘কিনবে না কেন! ফিলানথ্রফি! চা, কফির মত – আমাদের না - ওদের। বলতে পারো corporate social responsibility - আমরা যে কবিতা নিয়ে এত কাঠখড় পোড়াচ্ছি তার কিছুটা অন্তত দায় তো ওরা নেবে’! আমার ধারণা, নিজের আনন্দ, খেয়াল বা রুচিতে কবিতা লেখা হবে অতখানি ঠিক, কিন্তু কেউ সেটা পড়বে তার দায়িত্ব কবির। এবং এই কেউটা universal কেউ। পাড়ার প্যালাদা টেনিদা নয় বা প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন্ বারীণদা অলোকদা রঞ্জনদারাও নয়। বেশির ভাগ কবিই এই ভেবেই লেখে বা এই প্রত্যাশা মনে পুষে রাখে যে কেউ সেটা পড়বে - মনের তাগিদে বা চিন্তার খোরাক জোটাতে বা যে কারণেই হোক।

দীপঙ্কর 2005 সাল থেকেই, তার মা মারা যাওয়ার পর মানসিক অস্থিরতার ভেতরে ছিল। এই ঘটনার কয়েক বছর আগে তার স্ত্রীর সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় যেটা জোড়া লাগে নি ডিভোর্সও হয় নি। মা মারা যাওয়ার পর সে তার মায়ের কালকাজীস্থিত ফ্ল্যাট বিক্রি করে কিছুদিন মুনিরকা অঞ্চলে ভাড়াবাড়িতে থাকে ও বছরখানেকের ভেতরেই গজিয়াবাদের তুলসী নিকেতন এ ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই বাস করা শুরু করে। এর ফলে তার চেনাপরিচিত মহল থেকে অল্প অল্প করে দূরে সরে যেতে থাকে।

মায়ের চলে যাওয়ার পর দীপঙ্কর যে পরিমান একা হয়ে যায় যার তুলনা তার আগের জীবনে সে কোথাও পায়নি। শোকগ্রস্থই ছিল বেশ কয়েক বছর। সে সময় যা কিছু লিখছিল সেগুলো আড্ডার বাহবা পাচ্ছিল যথারীতি কিন্তু তার নিজের মনেরই তাতে সায় ছিল না। সে রকম ভাবে লেখেও নি। বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ও ‘শুণ্যকাল’ নামের এই ওয়েব ম্যাগাজিনটি দীপঙ্কর শুরু করে ও এই নিয়ে বেশ মশগুল থাকে। অনেক নতুন কবির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সম্পূর্ণ নিজের প্রয়াসে গড়ে তোলা ও নিজের মনের কাছাকাছি এই সাহিত্যকর্মটি তাকে ব্যস্ত রেখেছিল বিগত কয়েক বছর। ‘শুণ্যকাল’ পর্যায়েই দীপঙ্কর আবার নতুন করে কবিতায় আসে।

কবিতায় যেমন সে একটা কবিতা দুবার লিখত না আর সবসময়ই নতুন কিছু লিখত নিজের জীবনেও সে একটা পরিধির ভেতরে নিজেকে বেশিদিন জড়িয়ে রাখত না।  কবিতা নিয়ে থাকতে ভালবাসলেও তার আগ্রহের /অনুশীলনের জায়গায় অনেক কিছু ছিল। শেয়ারবাজারের ওঠানামা যেটা ছিল তার পেশার জায়গা সেটার অনেক খবরাখবর রাখত শুধু নয় সাইবারে অনলাইন এবং সেখান থেকে রিয়েলটাইম গ্র্যাফিক্স তুলে নিজের রিসার্চ করত। আর একটা তার  দখলের জায়গা ছিল ভৃগুশাস্ত্র। কুষ্টি-ঠিকুজী বুঝত, কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রাথমিক গণিতটি তাতে কষে নিয়ে নিজে তার অর্থ উদ্ধার করত ও জাতক-জাতিকাকে জানাত।  হোমিওপ্যাথি ও বিভিন্ন দেশজ চিকিৎসার জ্ঞান আহরণ করত ও তা নিয়ে চেনাপরিচিত মহলে টোটকা  চিকিৎসার একটা ব্যাপারও তার ছিল। কিন্তু শেয়ারবাজার ছাড়া আর কোন কিছুতে সে কোন উপার্জন ঈপ্সা রাখত না।  শেয়ারবাজারেও তার উপার্জন অল্পই হোত বেশির ভাগ তার পরামর্শ নিত এবং সুফল পাওয়ার পর দীপঙ্করের প্রাপ্যটি দিতে অতিরিক্ত কার্পণ্য দেখাত। ওর কুষ্ঠি ঠিকুজী দেখার রহস্যময়তা আমাকেও আচ্ছন্ন করেছে কখনো কখনো যখন বারবার দেখেছি লোকে এসে বলছে ওর ভবিষ্যৎ বিশ্লেষন সঠিক হওয়ার কথা। দীপঙ্করকে টাকা দিতে চেয়েছে এই সব লাভার্থীরা, সে নেয়নি এটাও দেখেছি।

স্বল্পায়ু, আমাদের হাতের নাগালের দীপঙ্কর যখন ছিল তখনো নাগালের বাইরে থাকা ওর খেয়ালখুশির ব্যাপার ছিল আবার জেদ পড়ে এলে উশখুশ করত কবিদের কাছাকাছি ফিরে আসতে। এখন আর ওর এই ট্যু-ওয়ে খেলাটা আমরা আর দেখব না। এখন আমাদের যোগাযোগের রাস্তা শুধুমাত্র ওর ফেলে যাওয়া কবিতা। সেটাও হবে ওয়ান ওয়ে। ওর কবিতা ওর মত করে না বুঝলে, ওর কবিতা ভাবনার বাইরেকার কথা তুললে, ওর টিপিক্যাল প্রতিক্রিয়া, রোষ আমরা আর দেখতে পাব না।  

1 comment:

Facebook Comments