উমাপদ কর

 

তিন দীপঙ্কর

উমাপদ কর



কী লিখি? কী যে লিখি? পীযূষ বলেছে, লেখায় অন্ততঃ ষাট থেকে পয়ষট্টি শতাংশ যেন শুধু দীপঙ্করের কবিতার কথাই থাকে। কিন্তু লিখতে বসে শুধুই যে দীপঙ্কর। নানা রূপের নানা রঙের নানান ভঙ্গিমার। হ্যাঁ, তাতে তাঁর কবিতাও জড়িয়ে রয়েছে। জড়িয়ে রয়েছে তাঁর সম্পাদক পালকগুলো। কিন্তু মধ্যমণি দীপঙ্কর। আবেগগুলো ঝরিয়ে ফেলব কীভাবে? ভালোবাসা আর টান, সে কি নির্মোহ হতে পারে? আর এ-কদিনেই শোক-তাপ-কষ্টানুভূতি ভুলে যেতে পারব? দীপঙ্কর বয়সে আমার চেয়ে দশ-এগারো বছরের ছোট। এ লেখা তো আমার লেখার কথা ছিল না। ওরই উচিৎ ছিল, আমাকে নিয়ে এমন কিছু লেখার। অবশ্য ও লিখত কিনা, সে নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ। হয়ত তেড়ে গাল দিত। হয়ত কেঁদে ফেলত। হয়ত আবেগে ভেসে ক’পাত্র বেশিই খেয়ে ফেলত। হয়ত অজানা আগ্রহে ঠিকুজি-কুষ্ঠি নিয়ে বসে যেত আমার মৃত্যুকালীন তিথি-নক্ষত্রের অবস্থান সঠিক ছিল কিনা! হয়ত… , না, থাক… থাক এসব…। কিন্তু কী যে হয়ে গেল, আমাকেই তার জন্য…। অগত্যা, বাধ্যত, আমিই…

আমার শরীর থেকে খুলে পড়ুক বর্ম। ছেদিত হতে ভয় যেন আমাকে গ্রাস না করে। আমার মনের ঠুলিগুলো ভেঙে পড়ুক। অকপট হতে আমি যেন কৃপণ না হই। সমস্ত অর্গলমুক্ত আমি নামিয়ে রাখি আমার আস্তরণগুলো। এক্ষণে প্রবেশ করি তিন দীপঙ্করে। কবি, সম্পাদক, ব্যক্তি।

২০০৭ সালের কোনও এক শীতচটা প্রথমদিকের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা বই-মেলায় বারীনদা (কবি বারীন ঘোষাল) ‘কৌরব’ স্টলের সামনে আমার হাতে লালরঙা মলাটের (একটু ঢাউসও) একটা কবিতার বই তুলে দেন। নাম “দীপঙ্কর দত্ত’র কবিতা”। সেবারে দীপঙ্কর মেলায় আসেনি। তার বছর দুয়েক আগে ২০০৫ সালে কলকাতা বইমেলাতেই দিল্লির আর কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক সমেত দীপঙ্করের সঙ্গে আমার পরিচয় আর সামান্য আলাপ। দু-বছরে তাঁর সঙ্গে খুব সামান্যই কিছু কথাবার্তা টেলিফোনে, মেসেজে। তবু যে সে আমাকে তার বই দেওয়ার তালিকায় রেখেছিল, সেটাই আমাকে তখন বেশ প্লুত করেছিল। এই বই-এর আগে আমি দীপঙ্কর দত্তকে সেভাবে পড়িনি। খুব বিচ্ছিন্নভাবে একদম হাতে গুনে দু-চারটে। প্রথম পড়ি ‘কবিতা ক্যাম্পাস’-এর ৫৬তম সংখ্যায় (অক্টোবর-২০০৪)। একটাই কবিতা, না্ম, ‘ব্রিজঘাট’। এর পর পড়ি ‘দিল্লি হাটার্স’-এর ৪র্থ সংখ্যায় (জুন-২০০৬)। একটাই কবিতা, নাম, ‘ফ্লু’। যদিও দিলীপদা (কবি দিলীপ ফৌজদার, দিল্লি হাটার্সের সম্পাদক) তার আগের একটা সংখ্যা আমাকে ২০০৫-এ দিয়েছিলেন। তাতে দীপঙ্করের কবিতা ছিল না, ছিল তাঁর বই-এর বিজ্ঞাপন – ‘নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা’। তো, সামান্য এই পাঠের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ‘দীপঙ্কর দত্ত’র কবিতা’ আমি পড়েছিলাম। সম্প্রতি বহরমপুর গিয়ে আমি তাঁর বইটি আবার বার করি। অবাক হয়ে সেই বই-এই মধ্যে আমি পেয়ে যাই একটি চিঠির কপি। চিঠিটি আমিই দীপঙ্করকে লিখেছিলাম বইটি পড়ার পর। তাৎক্ষণিক সামান্য পাঠ-প্রতিক্রিয়া, খুব সংক্ষেপে এবং সম্ভবত একটু নির্মমভাবেই। এখানে চিঠিটি রাখি। তাহলে বোঝা যাবে ১০ বছর আগে আমি তাঁকে কী বলেছিলাম, এবং জানাবো চিঠির প্রেক্ষিতে দীপঙ্কর টেলিফোনে আমাকে কী সব বলেছিল।
                                                                                                            বহরমপুর, ৬ মার্চ ২০০৭

সুপ্রিয় দীপঙ্কর দত্ত,

নমস্কার, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা। বইমেলা ০৭-এ আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। বারীনদার মাধ্যমে আপনার কবিতার বই-এর সঙ্গে দেখা। (সম্ভবত বই দেওয়ার তালিকাটি আপনারই তৈরি)। পরে, পড়ে আলাপ পরিচয়। সেই নিয়ে অকিঞ্চিৎকর দু-চার কলম।

কবিতার কোনো বেড়া-জাল থাকতেই পারে না। বহু মানুষ চেষ্টা করেও তা রাখতে পারেনি। কিছু মানুষ বে-লাইন হবেই। এই কিছু মানুষের আপনি কি কখনো কবিতাকে নৈঃশব্দের কাছে পৌঁছে দেবার কথা ভেবেছেন? ভেবে দেখবার সব রসদই এই বই-এর মধ্যে আছে। অথচ মিছিমিছি বড় কথা হয়ে গেল না! কথার সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে বের হলো অসম্ভব রাগ দ্রোহ অভিমান, চুইয়ে এলেও বেশ উচ্চকিতই বোধ হলো বেদনা আর বিষাদ। বিপরীতে ভালোবাসার কথাও তো কম হলো না! বইটির অধিকাংশ কবিতায় মজেছি যেমন, তেমন কবিরই স্বেচ্ছাচারে কিছু কবিতা দমফুট দিশেহারা। না কি আমিই?

এক অসমান্তরাল যাপনের চালচিত্র নয় শুধু, উঠে এসেছে তার সশব্দ চিৎকার, এমনকি গন্ধও। যাপন ও কবিতাযাপন একাকার তার মজ্জায় শ্লেষ্মায় আর হাড়ে। বাঃ বলেই থমকে যাওয়া যায় না। আরও কিছু থাকে। থেকে যায়…

আমি গিলেছি এর ভাষাপ্রয়োগের চমৎকারিত্ব, কিন্তু সবসময় হজম করতে পারিনি। অভ্যস্ত নই তো! চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু এ-তো আভিধানিক নয়, যে অর্থ খুঁজব! অনেক সময় স্বতোৎসারিত সেই ভাষা-প্রকল্পে আহা-উহু করলেও আস্বাদনে কোথাও অন্তরায় থেকে গেছে। কিন্তু অমোঘ মনে হওয়ায়, মনে হওয়ায় যে, না, এর চেয়ে অন্যরকম কিছু হতেই পারে না, আশ্চর্য হয়েছি। বুঝেছি আপনি আলাদা, অন্যরকম। তো, ধুন্দুমার, চলুক এমন…

একটা কথা, ভাই, কবিতা শুরু হওয়ার আগে এত বড় একটা গদ্য কেন? অনাবশ্যক মনে হয়েছে।
ভালো থাকুন, ভালো লিখুন, ভালোবাসা নিন।

উমাপদ কর।

ক’দিনের মধ্যে এই চিঠি পেয়ে দীপঙ্করের ফোন। (চিঠিটা যেমন কপি থেকে, ফলে হুবহু…, এ তা নয়, স্মৃতি থেকে, সংক্ষিপ্ত এবং যতটা সম্ভব।) “ও মাই ডিয়ার! এতো প্রশংসার সঙ্গে এতো গালও মেশানো যায়!... মাইরি, ভাবিনি কখনো। গিলছি…, সহজপাচ্য নয়, এভাবেও কেউ বলেনি। বলেছে বদহজম হয়েছে। তুমি মাইরি গুরু। জিও বন্ধু।” ইত্যাদি। সেই-ই আমাকে প্রথম বন্ধু ডাকলো। ধীরে বন্ধুই হয়ে গেলাম। ‘উমাদা’ ডাকটা ছিল পোষাকি।

আজ দশ বছর পর ‘দীপঙ্কর দত্ত’র কবিতা’ নিয়ে কি আমার একই ভাবনা, একই বিশ্লেষণ? চিন্তন কাঠামোটি মোটামুটি একই থাকলেও ভাবনায় অনেক পালক জুড়েছে। বিশ্লেষণে লেগেছে রং আর ফুলঝুরি। এর মধ্যে দীপঙ্করে অভ্যস্ত হয়েছি যে অনেকটা। হড়পা বানের প্রথমটা কাটিয়ে উঠেছি। হঠাৎ পাওয়া উচ্চ-ঘাতের ধাঁধসটাও অনেকটাই গা-সওয়া এখন। লিখেছিলাম বে-লাইনের কথা। হ্যাঁ, এ-কবিতা প্রথা-মানা কবিতা নয়, ধারা কবিতায় অনুগমন নয়। তাহলে এসব কবিতার ধরতাইটা ঠিক কী?

ইতিমধ্যে বাংলা কবিতায় অনেক কটি আলোড়ন আন্দোলন আমরা লক্ষ্য করেছি। এ কি তারই মধ্যে বিশেষ কোনও একটি? পোস্টমডার্নিটির প্রতি দীপঙ্করের একটি নরম ভালোবাসার জায়গা আছে জেনেও প্রশ্নটি তুললাম। একটা কবিতার কথায় আসি। বই-এর দ্বিতীয় কবিতা, ‘ফ্লটস্যাম’ (পৃঃ-১২)। শুরুই হচ্ছে—

  “কশে চাবুক মারো,
   চিড় খাওয়া জল মুহূর্তে জুড়ে যায় ফের
   শুধু কোপানো, খাবলানো পিঠ, পাছা ও পাঁজরগুলি
   হাঁ হয়ে থাকে
   ব্যাসিলাসময় রৌদ্রের সিরাম, নোসোডগুলি
   ছুঁয়ে যায় জায়মান বীজ—”

একটা উচ্চকিত অবস্থান থেকে শুরু। যদি শুরু করা হতো— ‘চাবুক মারো’, তাতে যে অভিঘাত সৃষ্টি হতো, তা না করে, ‘কশে’ শব্দটির ব্যবহার যে উচ্চগ্রামের অভিঘাত তৈরি করল, তা যেন গ্রাফ-পেপারের শূন্য অবস্থানের প্রেক্ষিতে একদম মাঝ-বরাবর থেকে। পরে আমরা লক্ষ্য করব, লেখটি আরও উর্ধ্বগামী। কচিৎই সে নেমে এসেছে ভূমির দিকে নত হয়ে। এখানে, ‘শুধু কোপানো, খাবলানো পিঠ, পাছা ও পাঁজরগুলি/ হাঁ হয়ে থাকে’ দু-পঙক্তিতে ষাটের একটি বিশেষ আন্দোলন-আলোড়নের স্পর্শানুভূতি জাগর হলেও অচিরেই দেখি ‘ব্যাসিলাসময়’ শব্দ জোড়টি, দেখি ‘রৌদ্রের সিরাম’-এর মতো এক অদ্ভুত বিমূর্ততা, যা আবার নব্বই-এর একটি বিশেষ আলোড়নকে মনে করিয়ে দেয়। ‘নোসোডগুলি/ ছুঁয়ে যায় জায়মান বীজ—’ কি আদৌ বিনর্মাণ বিগঠন ইত্যাদিকে মনে করিয়ে দেয়!

  “ধাতব নৈঃশব্দের ভার্টিগো, নিউর‍্যালজিয়া নিয়ে এখন
   মেশিনরুম থেকে পথে—
   অপর প্রান্তে ধ্বংস স্যানাটরিয়াম,
   গোধূলীর আগ্নেয় বলয় বেষ্টনে কাঁপে কিউমুলো-নিম্বাস;
   ক্ষিপ্র চাকুর মুখে রূপোলী প্লাকয়েড আঁশ
   উঠে আসে স্নায়ব স্বপ্ন—”

‘ধ্বংস স্যানাটরিয়াম’, ‘গোধূলীর আগ্নেয় বলয়’, ‘ক্ষিপ্র চাকু’। দেখুন, আবহে সব কিছুতেই কেমন একটা ভেঙে ফেলা, চড়া, তছনছ করে দেওয়া, একটা ধুন্দুমার, একটা ক্ষিপ্রতা। আর বয়নে কবির ওতপ্রোত জড়িয়ে-থাকা ভঙ্গির মুন্সিয়ানা। ধাতুতে নৈঃশব্দ একদম বিপরীত অবস্থানের চিন্তা, তার আবার ভার্টিগো। মেশিনরুমের বিপরীতে স্যানাটরিয়াম। চাকুর মুখে প্লাকয়েড আঁশ। আর এইসব বৈপরীত্যে গড়া স্নায়ব স্বপ্ন। ধ্বংসের এই আবহে দীপঙ্কর কত সহজেই না মেলে ধরছে তার রোমহর্ষকতা। আর ভেঙে ফেলার মধ্যে রেখে দিচ্ছে এক স্বপ্ন সম্ভাবনা।

   “তোমার বমি ও ঝড়ের টেক্সট্ ও গ্রাফিক্সগুলি
    যদি মড়কের মতো নগরে বন্দরে
    ইস্পাতধৃত রাত্রির শূট-অ্যাট-সাইট প্যারাপ্লেজিয়া
    ব্যারেল দু’রগ ছুঁয়ে
    কোঁকে, অণ্ডে সবুট লাথির মায়ায়
    আদি ঘাসের রিক্ত প্লাসটিডে জমে রক্ত-গ্যাঁজলা —
    ‘অপাচ্য হাড়-গোড়-পাথর – যা কিছু উঠে আসে
    গিলে ফ্যাল্ ফের—
    ওয়াক তুলবি ক্যানো, ক্রীতদাস ওয়াক তোলে না…।’”

পরিস্কার আগের দু-স্ট্যাঞ্জার সব কিছু ব্রেক করে লেখ-কে করে দেওয়া হলো আরও উর্ধ্বগামী। প্রায় বাঁধনহারা। ‘তোমার বমি ও ঝড়ের’ দিয়ে শুরু হওয়ায় যখনই মনে হতে লাগল ষাটের সেই আন্দোলন ধারার ফসল হয়ে উঠছে, তখনই ঝড়ের সঙ্গে ‘টেক্সট্ ও গ্রাফিক্সগুলি’ ইত্যাদি দিয়ে ভেঙে দেওয়া হলো তার অবিকলত্ব। নিয়ে যাওয়া হলো প্রায় অকল্পনীয় এক অনুষঙ্গে। আবার ‘অণ্ডে সবুট লাথির মায়ায়’ বৈপরীত্যের যে বিমূর্ততা রচিত হলো, ভাবনার যে সম্প্রসারণ ঘটানো হলো, অচিরেই তা ভেঙে দেওয়া হলো একটি ডায়লগে। ‘অপাচ্য হাড়-গোড়-পাথর … … ক্রীতদাস ওয়াক তোলে না’। এই উদ্ধৃতিমূলক বচন আবার সেই ধারার কবিতায় অপাঙক্তেয়, সেই কবিতাধারার অলিখিত ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে খাপ খায় না। আর একটাও নতুন শব্দ আমদানি না করেও অনায়াসে লেখা হচ্ছে, ‘ইস্পাতধৃত রাত্রি’, ‘সবুট লাথির মায়ায়’, বা ‘আদি ঘাসের রিক্ত প্লাসটিডে’ ইত্যাদি। 

   “তোমার হ্যাপ্লয়েড পৃথিবীর নিউক্লিয়াসে এখন অতীন্দ্রিয় আলো –
    ক্রাচে, হুইল চেয়ারে, স্ট্রেচারে যে কোনও
    করিডর পথে তুমি যাও,
    এখানে বসন্ত আজ; দু’স্তন ওপচানো দুধে
    নার্সের অ্যাপ্রণ ভিজে গ্যাছে –”

লেখটি এবার নীচের দিকে নেমে আসছে। গ্রাফের শূন্যের কাছে, ভূমির কাছে নেমে এসেছে। সেই উচ্চনাদ আর নেই। নেই রোমহর্ষক ভেঙে ফেলা, ধ্বংসের উন্মত্ততা, এখন সে শান্ত, আরও শান্ততার দিকে তার অভিযাত্রা। ‘পৃথিবীর নিউক্লিয়াসে’ সে পেয়েছে ‘আলোর সন্ধান’। এক পরাবাস্তবিক চেতনায় ভাস্বর হয়ে উঠছে সে, উপলব্ধি করছে বসন্ত, আর দেখছে স্তন-দুগ্ধে ভেসে যাচ্ছে পরিধান।

এই হলো দীপঙ্কর। বাঁধা থাকেনি, বাধ্য থাকেনি। নিজের মতো করে চলেছে, নিজের মতো করে কবিতা করেছে। পোস্টমডার্ণ ভাবনার খুব কাছাকাছি বসত তাঁর। কিন্তু সেটা শেষ কথা নয়। যেমন এ কবিতায় আমি বিনির্মান, বিগঠনের চেয়ে নির্মাণ আর গঠনই বেশি লক্ষ্য করেছি। বিষয়ের গাঢ় কেন্দ্রীকতা নেই ঠিকই, কিন্তু বিষয়ভাবনার স্ফুরণ আছে, একটা বলতে চাওয়া আছে। আবার নব্বই-এর আরেকটি কাব্যধারার সঙ্গেও অনেক ক্ষেত্রে যায়, কিন্তু পুরোটা না।

এতো গেলো মধ্যবর্তী অবস্থানের একটি কবিতা। এই বই থেকে আর একটি কবিতার উল্লেখ প্রয়োজন, যেখানে দীপঙ্কর অতীশ হতে চাইছে। আরও ধুন্দুমার, আর ঝনঝনানি। মানে উচ্চবর্তী অবস্থানের কবিতা। নাম ‘ফ্লু’ (পৃঃ-৫৫)। গোটা কবিতাটাই তুলে ধরতে হবে একটানা। তারপর কথাবার্তা, নয়ত তাল কেটে যাবে।

  “সাপ জিভের দু’ফলা রেণু রেণু পুংকেশর দরমেয়ান গোঁজ বিঁধে থাকে
   ক্লিটবুড়ির ছ্যাঁচা দোক্তা ঝাঁঝের গা পিছাপিছা অ্যামোনিয়ার
   নাব্য থোল থোল উঙ্গলীর বাগিচী গুলাব
   স্টিমইঞ্জিন মার্ডারের দুই অহম হস্টাইল গবাহকে দ্যাখ ছুটছে
                 টিলার আটঠালি অপু পাটঠালি চোরবালির রেঙ্গতা দুগ্গা
   একটি ঝাক্ লাক্ এলো কুউ পেন্নাম কত্তা ঠিস্‌টাক্
   আমাদের ঘটিজল গামোছ পামোছ দাওয়ার নকশালবাড়ি
   ব্লাস্টা ভ্যাংচা ব্রড গেজ
   না কাগ চিলানী মা সির্ফ উল্লু বোলে
   প্রতিটা কুটুম ইস্টি শান খায়   প্রতি প্ল্যাট ফর্ম নিচ্ছে
   বদরা অয় কাজরা তেরি কারে কারে মরচে ফেটে ফেটে -- 
  কম্বলে এমন কি জবরজঙ্গী গয়াগুজরা এক রাত বাথানে লুকোলে
  সিঁটিয়ে ডুকরে ওঠে পশুথন
  বিষানো দুধ খাওয়া ম্যানিক আউশ আমন ভুরা বকনাদের এট্টু রাইম দে
  উলঝা খ্যালা দে জোঁক লুডো
  ব্রীজতলার আখাড়া থেকে উঠে আসা ষোলো হোমো পহেলবান খুঁটির
  কারো যদি লবণে রক্ত ওঠে স্যাণ্ডেলে ঠাসাভাঙা ছেঁইচ্যা দিস রামা
  যা দেবেন, ছেলেরা ডালের ওপর একটা ভাজাও চায় না মাসিমা
  আথালের জংলা মশার কবলে কার আর ঘুম আসে
  তবু ডাকার কথা ভোর রাতে একবার অবশ্যই ডাকবেন পল্লব
  চা-ও চাইবেনা বেসিনে চোখে আঁজলাভর ঝাপট বে্রিয়ে যারে থলি কাঁধে
  টমেটো দিয়ে নতুন গুড়ি আলু পেঁয়াজপত্তার কেরম
  লাল লাল ঝাল একটা চড়চড়ি কশাননা পূবাকাশ
  ঝুণ্ড ছুট খ্যাপা অলিশান দিঙবারণ উঠে আসে ঘায়েল একদন্তা
  খোঁয়াড়ের জ্বোরো মুর্গীগুলো খেয়ে গেরামে এখন শেয়ালের ফ্লু
  কাঠি কাঠি হুত্তাহুয়া ঠ্যাং ধরার টুচ্চা উনপাঁজর কল পিষে এগিয়ে যায় ঐরাবত
  চার জগদ্দল পায়ে – ”

কী, পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হলো না বারবার? মনে হলো না এ কোন ভাষার কবিতা রে বাবা! শব্দ-সন্ত্রাস মনে হলো? হতেই পারে। আগের কবিতায় আমরা অনেক ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখেছিলাম। এবারে দেখছি ইংরেজি ছাড়া আরো ভিনভাষা। এমনকি বাংলা ভাষার কলোকালও। সবার সম্মিলনে এক নতুন পরিসর। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে কতটুকু মানা যায়? একে বাংলা ভাষায় এতো ভিনভাষার শব্দ আর শব্দবন্ধ। তার ওপর বাংলা-ভাষায় বাক্য-গঠন পদ্ধতির (সিনট্যাক্স) অদল-বদল ঘটিয়ে এক অচেনা স্বর উপস্থাপন। কতটুকু মান্যতা পেতে পারে? কবিতায় শব্দ ব্যবহৃত হয়ে যদি তা চলমান না হয়, যদি অভিঘাত সৃষ্টিতে অক্ষম হয়, তবে তা মৃত শব্দ। সে শব্দ ব্যবহারে গতি রুদ্ধ হয়, ভাবনা প্রতিফলনে অসমর্থ হয়। কিন্তু দীপঙ্করের শব্দ ব্যবহারে আমি তা পাচ্ছি না। এ শব্দ চলমান, গতি দিচ্ছে। ভাব ও ভাবনা প্রসারে অসুবিধা ঘটাচ্ছে না। তাহলে, অসুবিধা কোথায়? সংস্কারে অসুবিধা থাকতে পারে। কিন্তু দীপঙ্কর তো সংস্কারমুক্ত হয়েই কবিতা করতে চেয়েছে, চায়। হ্যাঁ, পাঠে কিছু কসরত করতে হয়, কিন্তু তা সাময়িক। একবারে হয় না, ঠোঁট জিভ দাঁত তালব্য একটু সইয়ে নিতে হয়। এই যা…। কিন্তু রসের জোগান কমে না, বই বাড়ে। কথ্যস্য কথ্য কবিতায় প্রাণ পায়। হতে পারে নিরন্তর শব্দ আছড়ে পড়ার ঝংকারে বোঝার ব্যাপারটা যথেষ্ট টাল খায়। কিন্তু কবিতা বুঝিয়ে দেওয়ার দায় দীপঙ্কর নিতে চায় না। নেবেই বা কেন? অনুভবের জায়গাটা কিন্তু সেভাবে মার খায় না। যেমন এ কবিতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরের প্রেক্ষাপটে শ্লেষে বিদ্রুপে স্যাটায়ারে কিছুটা রূপকের আড়ালে রেখে এমন এক আবহ ও পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে যা অনুধাবনযোগ্য। “ব্লাস্টা ভ্যাংচা ব্রড গেজ/ না কাগ চিলানী মা সির্ফ উল্লু বোলে/ প্রতিটা কুটুম ইস্টি শান খায়   প্রতি প্ল্যাট ফর্ম নিচ্ছে/ বদরা অয় কাজরা তেরি কারে কারে মরচে ফেটে ফেটে—”। কখনো শব্দকে ভেঙে আলাদা ভাব ও মাত্রা দিয়ে আবার কখনো একাধিক শব্দ জুড়ে, কখনও প্রচলিত বাক-ভঙ্গিটির বদল ঘটিয়ে, বাংলার সঙ্গে হিন্দী, উর্দু, ইংরেজির মিশেলে এই ভাষা-প্রকল্পে দীপঙ্করের যাত্রাপথ। শব্দ-সন্ত্রাস, বিভাষা, এসব বললেও দীপঙ্করের কিছু যায় আসে না। কেননা, এটা তাঁর অধিগত, সে নিজে ফ্লুয়েন্ট। দীর্ঘদিন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে রাখার, নিরন্তর এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ফসল হিসেবে উঠে এসেছে, এবং এতেই কবিতা করতে চেয়েছে সে, করেছেও। এতসবের পরেও বলব, কিছু কবিতায় অতিশোয়ক্তিও আমি লক্ষ্য করেছি। না, কোনো গিমিকের জন্য নয়, নয় কোনো স্টান্টের জন্য, স্রেফ অনেক সময়ই নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করতে না-পারার জন্য। অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা আর সেন্টিমেন্টাল অবস্থানে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীপঙ্করের কাছে তা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে।

নিম্নবর্তী অবস্থানের একটি কবিতার কথা হোক তবে। ‘টোটা’ (পৃঃ-৩২)। টানাই পড়া যাক।
  
   “পিঁপড়েরা থোক থোক মুখে ডিম
    তোর ফাটলে সেঁধিয়ে যাবার প্রায় আঠারো ঘন্টা পর এই বৃষ্টি
    যে ফেরার কার্তুজগুলি
    রিভালবারের খোঁজে এসে দু’রাত হল্ট করে গ্যাছে
    তাদের সক্সের উৎকট বারুদ গন্ধের ব্যপ্তি এই ফিল্ড
    স্লিপে কেডস্
    গালি একটু কার্ভ হয়ে রুকস্যাক
    আর ফাইনলেগ ডীপ থেকে
    মৃত ডাহুকগুলির ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে
    ক্রিজের গা ঘেঁসে দাঁড়ায়
    খনিজ জলের এক ঠাণ্ডা বাস্পময় বোতল
    এদিকে ক্যাচ উঠছে নোম্যান্স ল্যাণ্ডে
    আমি শাবলের চাড় দিয়ে কফিন ডালার মতো
    তোকে শুদ্ধু উলটে দিচ্ছি গোটা পিচ
    আর দেখছি ঝাঁকুনি খেয়ে টায়ারের ফোকর গলে
    কাদায় বিজবিজ ছড়িয়ে পড়ছে পিঁপড়ের ঝাঁক
    আর জমাট বাঁধছে ডিমগুলি
    ভাসতে ভাসতে নেবে আসে
    লোড হয় তাবুদ-এর থার্টি-টু বোর এক রাতের প্রেক্ষায় —”

প্রথমেই ভাষার কথায় আসি। না, এখানে মিশেল দেওয়া ঠাসবুনট ভাষায় স্বরক্ষেপন নয়। এখানে চাল অনেক হালকা, চলন অনেক মৃদু। দু-চারটে ইংরেজি শব্দ ছাড়া ভিনভাষা নেই-ই। ফলে ভিন্ন স্বাদের দীপঙ্কর, যে আমাদের কেতু-মঘা-অশ্লেষায় ক্রমাগত ছুটিয়ে না-নিয়ে, প্রতিপদে কি তৃতীতায় নিয়ে এসেছে। এ-কবিতায় শুধুই স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে, সেটা আমি মোটেও বলছি না। বলছি উন্মত্ততা অনেক কম, আর ভাবনার জায়গাটি দখল করেছে এক তাৎক্ষণিক দর্শন। পরিসর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, একটি ফিল্ড, যেখানে ক্রিকেট খেলাও হতে পারে। মননে একটু শান দিলেই অনুভবে আসে জীবন-ক্ষেত্রটি। পাশাপাশি ও সমান্তরাল। একেকটি অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়েছে, আর উঠে এসেছে জীবনের অনুষঙ্গগুলো। মুহূর্তের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেখা স্পার্ক করে শুধু বড় পরিসরই তৈরি করে নেয়নি, একসময় তাকে পিন-পয়েন্টেডও করেছে। কবিতা হয়ে উঠেছে দক্ষতার হাত ধরে—“আর ফাইনলেগ ডীপ থেকে/ মৃত ডাহুকগুলির ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে/ ক্রিজের গা ঘেঁসে দাঁড়ায়/ খনিজ জলের এক ঠাণ্ডা বাস্পময় বোতল”। অসাধারণ। কবিতা হয়ে ওঠে তরঙ্গায়িত ভাবনার অসমান্যিকরণে—“এদিকে ক্যাচ উঠছে নোম্যান্স ল্যাণ্ডে”। আমিতো ‘ক্যাচ’ আর ‘নোম্যান্স ল্যাণ্ড’ ভাবি, আর ফিদা হয়ে যাই। ‘রাতের প্রেক্ষায়’ ‘থার্টি-টু বোর’ ‘লোড’ হলে আমি শুধু চমকেই উঠি না, জীবনে আস্বাদিত না হওয়া এক স্বপ্নে নিজেকে ফের উজ্জীবিত করতে পারি। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্রিকেট-ফিল্ড-রূপী এই জীবন-ক্ষেত্রটি কি একটা রূপকের আড়াল নিল না? নিতেই পারে। এসবে দীপঙ্করের থোড়াই কেয়ার। সে তাঁর কবিতাকরণের প্রয়োজনে আবহমান বাংলা কবিতার পুরোনো কৌশল গ্রহণ করতেও দ্বিধা ও কুন্ঠা করেনি।

তো এই হলো, এই পর্বের দীপঙ্করের কবিতা-কথা। এর পরেই তাঁর দীর্ঘ সময়ের বিরতিকাল। প্রায় পাঁচ বছরের বন্ধ্যা(!)সময়ের পর পরবর্তী পাঁচ-বছরে কাবিতা-বান ডাকতে পারত। কিন্তু তা দীপঙ্করের ধর্মের মধ্যে পড়ে না। তাঁর প্রসবে ভীষণ কষা। ক্ষণ-প্রজের মাত্র ৩০টি কবিতার সংকলন ‘ব্রেইলবর্ণ বিষহরি’। পাঁচ বছরে তিরিশ-বিয়ানো, গড়ে বছরে ছয়, দু-মাসে এক। থাকতেই পারে আরও অগ্রন্থিত কিছু, কিন্তু তাও যে খুবই সামান্য, তা হলফ করে বলতে পারি। পাথর কেটে যে মূর্তি গড়ে দিনের পর দিন গড়িয়ে, দীপঙ্করের কবিতা নির্মাণও অনেকটা সেইরকমের। সংগ্রহ, লালন, পোষন, সম্মীলন, কাটা, কুঁদা, ঝরিয়ে ফেলা, পুনরায় প্রলেপ, পরিবর্তন, রেখে দেওয়া, সময়ের নিরিখে পালটে দেওয়া, শুধুই বদলে বদলে আত্মারও সমূহ পরিবর্তন, শেষে হয়ত উজ্জীবন আর প্রাণ-প্রতিষ্ঠা। তাঁর এই প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির কথা অনেকেই জানেন। তারা অবাক না হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত নিয়ে কিছুটা অসহিষ্ণুতা আর দোলাচল নিয়ে হামলে পড়েন। যেমন আমি এখন। এই বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই হোক আমি কিছুটা জড়িয়ে পড়ায় কী যে একটা হতে যাচ্ছে তার কিছু পূর্ব-ধারণা আমার ছিলই। সেসব পিছনে ফেলেই, অগ্রসর হতে চাই।

বই-এর নামে একটা চমক আছে, যা, যে-কেউ স্বীকার করবেন। এটা দীপঙ্করের একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবেই আমি দেখি। তেমনি প্রচ্ছদ-ভাবনা, যেন বিষহরি বিষ হরণের চেয়ে বিষ-ভাবের রমরমায় শরীরী। আঁশময় সে শরীর ব্রেইলবর্ণকেই স্মরণ করায়, যে বর্ণে লিখিত হবে কবিতা। না, অন্ধের জন্য নয়, রীতিমত চক্ষুস্মানের জন্য।

গোটা বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, এ-পর্বে দীপঙ্কর পূর্ব-পর্বের দীপঙ্করকে খুব একটা ভেঙে ফেলেনি। ভেঙে গড়াও তেমনভাবে আমার নজরে আসেনি। তাঁর বাক-রীতিতে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করিনি। চেনা, সিগনেচার-ওয়ালা দীপঙ্করই আমার কাছে প্রতিভাত। সেই উচ্চারণ, সেই স্বর, সেই ভাষা-প্রকল্প, সেই উচ্চ-মধ্য-নিম্ন মেজাজ, ব্যক্তি-সমাজ-দেশ-কাল-পরিমণ্ডল, অনুষঙ্গ, আর শ্লেষ বিদ্রুপ স্যাটায়ার। সবকিছুকে খলখলে করে দেবার প্রেরণায় উজ্জীবিত, আবার তামসিক-ভাবখানায় থাকতে ভালোবাসার মধ্যে চুইয়ে নামা বিষাদ ও যন্ত্রনায় নিজেকে বিলীন করার ইচ্ছেটাও মরে যায়নি। পার্থক্য লেগেছে দুটো জায়গায়, এক মননে, দুই পরিশীলনে, যেখানে সামান্য হলেও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে। মননের পরিবর্তন স্বাভাবিক, যা সময়ের প্রবাহে হতে বাধ্য। আর পরিশীলন না-থাকলে কবির ভ্রমণ হতে পারে না। সংক্ষেপে কবিতার দিকে যাই।

এবারে আর গোটা কবিতা নয়, টুকরো-টাকরা দিয়েই আলো ফেলা যাবে। প্রথম কবিতা ‘ইছামতী’র প্রথম স্তবক।–

  “যথেষ্ট বর্গী বাৎসন্যায়ের পরও আলিয়ার ঠিক মোচন হয়না ফলে এমন চেঁচায় যে
   স্টীমার-এর যে কেবিনেই ছালায় শুয়ে পরছি আইদার দরজায় নক পরে নয়
   জানলার নিচ দিয়ে খেউড় পাড়তে পাড়তে একটা বোঝাই বজরা যায়
   কত্তা ইট্টু আইস্তে গো কুমীরগুলান ঘুমাইছে!”

প্রায় টানা গদ্যে এর বিস্তার, দাড়ি কমাহীন। দীপঙ্করের এই ভাষাকে শুধুই ‘ডায়াসপোরিক’ আখ্যা দিতে আমি গররাজী। কেননা এতে মাটির গন্ধ আছে, আছে শেকড়ের টান। এও সত্য তাঁর কবিতাকরণে ‘ডায়াসপোরার’ প্রভাব অনস্বীকার্য। তাঁর একটা নিজস্ব লেখন-কাঠামো রয়েছে যা নকল করা যায় না। এর ট্রান্সলেশন করাও ঝকমারি। খুব কম সংখ্যক কবি এভাবে কবিতা লিখেছেন। এটাও তাঁর অনন্যতা। এটা হতে পারে যে ‘পাওয়ার পোয়েট্রি’ রচনার যে প্রক্রিয়ার মধ্যে বেশ কিছু কাল দীপঙ্কর ছিল, এ তারই ফলশ্রুতি। এক, পাঠককে কোথাও থিতু হতে না-দেওয়া, তার মগজে মজ্জায় সজোরে আঘাত করা, দুই, যেন পুরোনো সংস্কারের আঁতে ঘা লাগে এবং প্রকৃত বাস্তবের মুখোমুখী হতে পারে।

দ্বিতীয় কবিতা ‘হ্রেসা’, তার দ্বিতীয় স্তবক—

  “সরো দেহি
  সারাদিন পক্ষীরাজ মাঞ্জা মাইরা বাজারে চরবা আর হাগবা আইসা ঘরে এই আথালে!
  পা সরাও চিঁহি, এট্টু ঝ্যাঁটাই নিকাই তোমাগো নীলরতন সরকার
  সওয়ারী নাই চাবুক নাই রাতভর কান পাইত্যা শোনো
  ক্ষুধা এই প্যাটের শত্তুরের চিকনি চুপড়ি আর মালসায় ভাত পিণ্ডির টগবগ
  একটা ঘোড়ার জন্ম হইলে দ্যাহন লাগে এক্কাকাগবগ্গাগো সাজো সাজো
  চাইম শিউরণ আহ্লাদি আটখানা ট্র্যাকে ও টার্ফে
  বরং হোগলাগুলি ফাইড়া লামাও, জাবনা খাও শোও বিছায়া বিছায়া
  কিন্তু আলো আসুক, চান্দের ছোবনাহান দেহি ফাটা চালে
  হাওয়ারাও বেবল্গা ওফোঁড় ওস্পার দেখুক মহীনের শপাং ল্যাশিংয়ে—”


কী অবিকল না? সম্ভবত এটাই দীপঙ্করের আদি ভাষা ছিল। এতদিন পরও ভোলেনি, টসকায় নি, আরোপিত মনে হয়নি। একমাত্র ‘ট্র্যাকে আর টার্ফে’ বাদে তাঁর পূর্বপুরুষের ভাষা অসামান্য দক্ষতায় সে কাজে লাগিয়েছে কবিতায়। এর আগের বা পরের স্তবকে কিন্তু তাঁর পূর্ব-চলন অব্যাহত। মিশেল। ওঁর মধ্যে ওঁর কবিতা নিয়ে একটা জাগ্লারি আছে। শূন্যে রেখে লুফতে পারে, এবং অনায়াসে। কখনো মনে হয় না যে সে কবিতা করছে, মনে হয় খেলছে-দুলছে, কোথাও একটা চলেছে পায়ে-পায়ে কখনো দৌড়ে, হাতে সেই কাঠি কিংবা বলগুলো, লুফতে লুফতে। অনায়াস। তবে কি স্বতস্ফুর্ত? স্বভাবজ? না, মোটেও তা নয়, আগেই বলেছি সে কুঁদে কেটে শব্দ বসায় সাজায়, প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। কিন্তু শেষে যেটা প্রেজেন্ট করে, তাতে আমাদের সেটাই মনে হয়, অনায়াস। আর এভাবেই কবিতার প্রাণকে কখন আমাদের প্রাণের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, আমরা অনেকসময় বুঝতেই পারি না।


‘বাহনুবাচ’ কবিতাটিতে (পৃঃ-১৪) একটা নীরিক্ষা চালানো হয়েছে বলে আমার মনে হয়। বাহন হিসেবে চারটি ‘কার’ সাব্যস্ত হয়েছে, যারা বিভিন্ন শহরের। এরপর বলা হচ্ছে উবাচ। যেমন সঞ্জয় উবাচ, যেন মহাভারত বলছে। কিন্তু এখানে খুব ভালো করে পড়ে আমি দেখলাম গাড়িগুলোকে চরিত্র বানিয়ে তাদের মুখ দিয়ে কিছুই বলানো হচ্ছে না। মহাভারতের কথা, তথা দেশ-কালের কথাই হচ্ছে, তবে তা যেন গাড়ি নয়, কবি নিজে নন, কোনও নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে বলা হচ্ছে, যেন ঘটে চলেছে এইসব, তারই কোনো রিলে। খুব অন্যরকম মনে হলো চালু দীপঙ্করের তুলনায়। এই কবিতায় এক ধরণের মজা উঠে এসেছে বলেই আমি মনে করি।

কবিতায় গল্প বলার প্রবণতা সাধারণত দীপঙ্করের কবিতায় দেখা যায় না। খুব সামান্য থাকলেও তা এসেছে আভাস হিসেবে, এবং ভাঙা টুকরো হয়ে। এই বই-এর দুটো কবিতা উল্লেখ করব যেখানে দীপঙ্কর এই সাধারণত কথাটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছে। অভ্যাসের বাইরে গিয়ে পরীক্ষা-ভিত্তিকভাবে কবিতায় একটা গল্পের আদল দিতে চেয়েছে। কবিতা দুটোর নাম— ‘কাঁঠালপাতা’ (পৃঃ- ১০-১১) এবং ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ (পৃঃ-১৮-১৯)। উদ্ধৃতি দিলাম না। পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। এখন প্রায় একই ভাষা-প্রকল্পে থেকে এই ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাওয়ায় উদ্দেশ্য তাঁর একটা ছিলই। কিন্তু সেটা আমি জানি না। ধারণা করতে পারি মাত্র। হয়ত নানাভাবে কবিতা বয়নের চেষ্টা করছিল সে। এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয়ও উল্লেখ করা যেতে পারে। এমনিতে আমি দীপঙ্করকে খুব একটা মিতবাক কবি হিসেবে চিহ্নিত করব না। তাঁর কবিতার স্বাভাবিক চলনের মধ্যে কথার দমক মোটেও কম নয়। কিন্তু এই বই-এ লক্ষ্য করেছি, প্রায় ৫-৬টি কবিতা রয়েছে, যা শুধু আকৃতিতেই ছোট নয়, প্রকৃতিতেও যথেষ্ট মিতবাক প্রবণতা বজায় রেখেছে। যেন হালকা একটা মোচড়, ছোট্ট দু-চারটে টান, আর তাতেই কৌটো থেকে বের করে নিয়ে আসা কবিতার প্রাণ-ভোমরাটিকে। কবিতাগুলোর নাম— ‘ফেরা’ (পৃঃ-১২), ‘সমারূঢ়’ (পৃঃ- ২৬), ‘সওদাগর’ (পৃঃ-২৬), ‘রঞ্জিশ’ (পৃঃ- ২৭), ‘কৃষি’ (পৃঃ-৩১) ইত্যাদি। এই সমস্ত কিছু কিসের ইঙ্গিত? আমার চিন্তা-ভাবনায়, দীপঙ্কর নানা কৌণিক দৃষ্টিতে নিজের ওপর আলো ফেলছিল, যেন তার বিচ্ছুরণে নতুনতর কিছু বেরিয়ে আসে। নিজস্ব সিগনেচারটি বজায় রেখে কবিতা নির্মাণে নিজেকে আরও সাহসী ও প্রাণবন্ত করার প্রয়াসে নিবেদিত হয়েছিল।

দীপঙ্কর ব্যতিক্রমী, দীপঙ্কর অন্যরকম। অনেক সময় দীপঙ্করের কবিতা নিয়ে ‘অ্যাবসার্ডিটি’র প্রসঙ্গটি আনা হয়। কিন্তু আমার ভাবনায় এবং মতে ওঁর কবিতায় ‘অ্যাবসার্ডিটি’ কিছু মাত্রায় নেই। এমনকি যে ‘অ্যাবস্ট্রাক্টনেস’ বা বিমূর্ততার কথা আগে উল্লেখ করেছিলাম তার পরিমানও যথেষ্ট কম। আপাতভাবে তাঁর ভাষা-প্রকল্পের জন্য এমন কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু অভিনিবেশ সহ  তাঁকে পড়লে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই বিশ্ব, এই সময়কাল, তার মানুষ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, অসাম্য-বৈষম্য, পীড়ন-অবদমন, ব্যক্তির আবেগ-উচ্ছাস-আনন্দ একাধারে অন্যদিকে ব্যক্তির দুঃখ-বেদনা-শূন্যতা, দ্রোহ-অভিমান এসবই তাঁর কবিতার উপাদান, অনুষঙ্গ, আর উপজীব্য। এমনকি প্রকৃতি ও নিসর্গও তুলনামূলকভাবে কম এসেছে তাঁর কবিতায়। দুটো পঙক্তি রেখে শেষ করি। -- “ কাঁটা চিবোতে চিবোতে এনলাইটেড উটেরা এখন আরো দীর্ঘকায়/ তবু রাস্তার কুকুর লাফিয়ে কামড়ে খাচ্ছে পিঠে বসা মানুষ—”। জানি, আরেক রকমের কবি দীপঙ্কর (এই দুটি বই-এর আগের) এবং কিছু বিষয় অনালোচিতই থেকে গেল। কিন্তু দীর্ঘতার কথা ভেবে, বলতেই হচ্ছে, পরে কখনও…।

ছাপা পত্রিকার যৌথ সম্পাদক দীপঙ্কর দত্ত সম্পর্কে (জিরো আওয়ার পাওয়ার পোয়েট্রি) আমার তেমন কোনো জান-পরিচয় নেই। দু-একটা সংখ্যা দেখেছি, এই পর্যন্তই। কিন্তু ওয়েব-ম্যাগ ‘শূন্যকাল’ সম্পাদক দীপঙ্কর সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আর সামান্য জান-পরিচয় আছে। প্রায় জন্মকাল থেকেই পত্রিকাটির সঙ্গে সে আমাকে কমবেশি জড়িয়ে রেখেছিল। আমিও তাঁকে সায় দিয়েই গেছি। কেমন সে সম্পাদনা, তার বিচার বিশ্লেষণ করা আমার মতো সামান্য কলমকারীর কাজ নয়। সেদিকে খুব একটা না গিয়ে বরং আমার দেখা আমার পাঠ আর আমারই সঙ্গে এর সংশ্রব নিয়ে দু-চার কথা বলি। প্রথম থেকেই ওয়েব ও ব্লগ-ম্যাগগুলোর মধ্যে ‘শূন্যকাল’ অনেকটাই আলাদা, অন্যরকম। এর প্রেজেন্টেশন, গেট-আপ, এর সূচী, বিভাগ, সর্বোপরী ভাবনার বৈচিত্র আমার দেখা-পড়া ওয়েব-ব্লগ-ম্যাগগুলির চেয়ে স্বতন্ত্র বলে মনে হয়েছে। একটা মার-কাট-কাট ব্যাপার-স্যাপার, একটা উত্তেজনা, এমনকি একটা রহস্যময়তাও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকত। কোত্থেকে বিভিন্ন ছবি পেইন্টিংস ইত্যাদি দিয়ে ও পত্রিকাটা সাজাতো যা একটা নির্দিষ্ট মেজাজ ও মনন তৈরি করে দিত। আর এই মেজাজ ও মননটা কবি দীপঙ্করের সঙ্গে খুব যায়। একটা বিভীষিকা, একটা দ্রোহ, একটা ভিন্ন ধরণের আমাদের দেখা অথচ ধরতে না-পারা জগৎ। আবার সেই জগৎটা ভাবতে ভাবতে এক ধরণের বিষাদ মন্থন। সাধু বলে উঠতে হত। প্রাথমিকভাবে দর্শক কিছুটা চমকে গেলেও অচিরেই তার মধ্যে কাজ করতে আরম্ভ করত এক ধরণের বিহ্বলতা ও বিপন্নতা— আমার এমনই মনে হয়। তাঁর পত্রিকা এলেবেলেভাবে ৫টা কবিতা, ৩টে গদ্য-নিবন্ধ-প্রবন্ধ বা দুটো গাল-গল্প-সাক্ষাৎকার-আড্ডা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে কখনো ব্যবহৃত হয়েছে বলে আমি অন্তত মনে করতে পারছি না। বিপরীতে ছিল একটা নির্দিষ্ট অভিমুখসহ প্রেজেন্টেশনের প্রবল ইচ্ছা। এই অভিমুখ ও মান ওয়েব-ম্যাগটিকে একটা গতি ও মাত্রা দিতে সক্ষম হত। তাঁর করা বিভাজন, বিভাগ, নামকরণ, ইত্যাদি সবাই জানেন, তা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, বলা দরকার এসবের অভিনবত্ব। আর সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন দক্ষতা। এটা ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা জানি অনেকসমই সে তাঁর চাহিদামত ও উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে লেখা-পত্র পায়নি বা জোগাড় করতে পারেনি। এই অভাবের মধ্যেও, এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেখতাম শেষমেশ সে যেটা নামিয়ে দিত, তা ফেলনা তো নয়ই বরং বেশ বুদ্ধিদীপ্ত আর আকর্ষণীয়। সম্পাদক হিসেবে কাকে দিয়ে কী করানো যায়, কী লেখানো যায় এটা সম্পর্কে ওঁর নিজস্ব কিছু ধারণা ও বিশ্বাস ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ধৈর্য ধরে লেগে থাকার ক্ষমতা। আমি অবাক হয়ে যাই, যে ব্যক্তি দীপঙ্কর ছটফটে অস্থির ধৈর্যহীন, সম্পাদক দীপঙ্কর কীভাবে এত ধৈর্য নিয়ে কন্সিস্টেন্টলি পত্রিকার ১৬ টি সংখ্যা প্রকাশ করে গেল। ব্যক্তিক মানসিকতাকে বদ্ধ রেখে, পত্রিকার স্বার্থে নিজেকে ছাপিয়ে একটা ভিন্ন বা প্রায় বিপরীত সত্তাকে উজ্জীবিত করা ও লালন করতে পারা আমার মতে এক বিশেষ গুণ, যা তাঁর ছিল। কী অদ্ভুত ভালোবেসে, কথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে, ম্যাসেজ-ইনবক্স-টেলিফোন ভরে দিয়ে, গাল-মন্দ-ধিক্কার জানিয়ে, চাপে রেখে, আবার অল্পেই যারপরনাই উচ্ছাস প্রকাশ করে সে প্রায় অসম্ভবকেও সম্ভব করিয়ে নিত তা আমি যেমন কিছু ক্ষেত্রে জানি, তেমনই অনেকেই অনেক ক্ষেত্রে তা জানেন। এখানে আমার দু-তিনটে অভিজ্ঞতা ছোট্ট করে বলে ফেলি। কথাবার্তা ধরা আছে সবই, টেলিফোনের অনেক কথাই মনে আছে, সে থাক। এখানে সময়কাল বা আগে পরে বিচার না-করেই। একবার কোনো একটা সংখ্যা প্রকাশের প্রায় তিনমাস আগে আমাকে জানালো— আগামী ‘শূন্যকাল’-এ তোমার কাব্য-ডায়রি প্রকাশ করব। দেড়-মাসের মধ্যে মেল করো। আমি জানালাম, পারবো না, এখন হবে না গো। কারণ ছিল, একে আমি খুব একটা লিখতে পারছিলাম না, তায় যা লিখছিলাম তা ছিল খুবই কম শব্দে ছোট ছোট পঙক্তিতে ৫-৬ লাইনের কবিতা, যার সঙ্গে কাব্য-ডায়রির যোজন দূরত্ব বলেই আমার মনে হয়েছিল। ও জানালো, হবে হবে, পারবে, এখন গরম, রাম ছেড়ে চিলড বিয়ার খাও, আর একটু বৃষ্টি পড়লেই হুইস্কি আর কলম একসঙ্গে চালাও, দেখবে ডায়রি ভরে গেছে। আমি জানালাম, ধ্যুস, আমি একটা অন্য ফেজ-এ আছি, এটা নষ্ট করতে চাইছি না। উত্তরই দিলো না। ক’দিন পরেই ইনবক্স ভরে গেলো দীপঙ্করের বাক্য-বাণে। বলা ঠিক হবে না। সুর একটাই, দিতে হবেই। বুঝলাম, ভবি ভুলবার নয়। এক-আধবার বসলামও। হলো না। জানালাম হচ্ছে না। তখন সে আমারই কবিতার বই-এর ‘কোট’ নামে টানা-গদ্যে লেখা একটা কবিতা টাইপ করে ইনবক্সে পাঠিয়ে দিলো, সঙ্গে মন্তব্য— এ-রকমটা চাইছি। অগত্যা সব ফেজ-টেজ ভুলে, বসা হলো বেশ ক’দিন। ফলশ্রুতিতে ৮-১০টা আবোল-তাবোল। দীপঙ্করের পাঠ। কথাবার্তা সাপেক্ষে একটায় সামান্য পরিবর্তন সহ গৃহীত। নাম দিতে পারলাম না। দীপঙ্করই নাম দিলো, ‘নি-নামচা’, কারণ জানালো, লিখতে তো চাইছিলে না, নামচা তাই নি-ই থাক। কৃতজ্ঞ হবে না, এমন কে আছে? পরে এই কবিতাগুলিই আমার দীর্ঘ কবিতার সংকলন ‘বালুমানুষের ঝুনঝুনাৎ’-এ সংকলিত হয়েছে। একবার জানালো, তোমার কোন এক প্রিয় কবির একটি কবিতা নিয়ে তোমার যা মনে হবে তা গদ্যাকারে লিখবে। সময় এক-মাস। এক মাস গেলো, আমার আর লেখা হয় না। তখনও প্রিয় কবিই বাছা হয়নি। জানালাম। খিস্তি দিল। দু-চারটে অকথ্য। কলকাতা এসে আমাকে কোন মাল খাওয়াবে, কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে, ইত্যাদি। একদিন পরেই কবিদের নামের তালিকা পাঠালো। আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু। সত্যি আমার প্রিয় কবি। আরও যাঁদের নাম পাঠিয়েছিল তাঁরা অধিকাংশই আমার প্রিয় কবি। বুঝলাম সে তার বেঁধে দিয়েছে। এবারে টুং-টাং আমায় বাজাতেই হবে। শেষে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা নিয়ে আমার সামান্য সংযোজন দীপঙ্করের কেন জানি ভালোই লেগে গেল। ‘শূন্যকাল-১৪’ নেট-বাহিত মনিটরে আসে ১৫ জুন, ২০১৬। তার দুই কি তিন দিন পর দীপঙ্কর আমাকে ফোন করে। জানায় পরবর্তী ইস্যু প্রকাশ পাবে ২৯ আগষ্ট, ২০১৬, তাতে তোমার কবিতা পাঠাবে। কিন্তু এটার জন্য ফোন নয়, ফোনের কারণ অন্য, আমি তারও পরের সংখ্যা থেকে মানে ‘শূন্যকাল-১৬’ থেকে ‘কথোপচারণ’ নামে একটা বিভাগ শুরু করব। তাতে বিভিন্ন জেলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সামাজিক অবস্থান-পত্র-পত্রিকা- বিশেষত কবিতাচর্চা ইত্যাদির একাল ও সেকাল নিয়ে তিন-চারজন ইমপরট্যান্ট কবির আলাপ-আলোচনা বা আড্ডা্র হুবহু কপি তুলে ধরা হবে। শুরু করার জন্য ভেবেছি বহরমপুর শহর তথা মুর্শিদাবাদ জেলার কথা। আড্ডাকাররা হবে তুমি, অমিতাভদা (অমিতাভ মৈত্র) আর প্রশান্তদা ( প্রশান্ত গুহ মজুমদার)। প্রকাশ পাবে মোটামুটি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। হাতে ছ-মাস সময়। এবার তোমাকে দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করে দিতে হবে। ইত্যাদি। আমি একটু থম মেরে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলব! আদৌ করতে পারব কিনা। কিন্তু দীপঙ্কর হাই-হুই করে, আরে দারুণ হবে, করলেই যে ব্র্যাণ্ড চাইবে তাই খাওয়াবো ইত্যাদি চিল্লিয়ে মিল্লিয়ে ফোন রেখে দিল। কিছু অসুবিধার কথা ভেবে পরদিন আমতা আমতা করে ইনবক্সে জানালাম, দ্যাখো আমাদের এক জায়গায় একসঙ্গে হওয়াই কঠিন। আমি কলকাতা, অমিতাভদা বহরমপুর, প্রশান্তদা মালদা। আমি বহরমপুর যাই ঠিকই, কিন্তু প্রশান্তদা তেমন আসে না। কীভাবে যে হবে, বুঝতে পারছি না। ইত্যাদি। জবাবে সঙ্গে সঙ্গে সে জানালো, আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি কালরাত্রেই। সবাই আগ্রহী। প্রশান্তদা বহরমপুর যাবে, তুমি গেলেই। অমিতাভদাও রাজী, থাকবে। আমি দায়িত্ব নিয়ে তিনজনের মোলাকাত বহরমপুরে করিয়ে দেব। বাকিটা তুমি সংগঠিত করো, প্লিজ। এতদিন আগে থেকে তাই এই মিশন। ইত্যাদি। সত্যি, এ শুধু কথার কথা নয়। একদম কাজে করে সে দেখিয়েছে। প্রথমবারে মিস হলেও, তাঁরই তাগাদায় আর লেগে থাকায়, পূজোর পরে প্রশান্তদা বহরমপুর আসে, দু-দিন ধরে তিনজনে আড্ডা বসে আমার বাড়ি। আড্ডা রেকর্ডিংও হয়। আর এই তিন-চার মাসে তাঁর সঙ্গে এ-বিষয়ে আমার প্রচুর চালাচালি হয়। তাঁর পত্রিকার চাহিদা, আলোচ্যসূচী, সাজেশন ইত্যাদি জানিয়ে সে আমাকে প্রকৃতই গাইড করে। আড্ডা শেষে টেলিফোনে জানালে সে শিশুর মতো উচ্ছাস প্রকাশ করে, আনন্দে দিশেহারা হয়ে খিস্তিসহ ভালোবাসা জানাতে থাকে, মেলায় এসে আমাকে মালে ভরিয়ে দেবে জানায়। তারপরেও সে আমাকে  বারবার স্মরণ করিয়েছে পত্রিকা প্রকাশের ডেট, জানতে চেয়েছে আমার অগ্রসরমানতার কথা। খুব সামান্য সংশোধনের পর, তাঁর মুখবন্ধসহ সে আড্ডা ‘শূন্যকাল-১৬’-তে প্রকাশ পায় ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬। ২২ ডিসেম্বর (‘শূন্যকাল-১৬’ প্রকাশের মাত্র ৪ দিন পর) সে আমাকে ইনবক্সে আবার জানায়-- “৯ই মার্চ শূন্যকাল বেরুবে। কোনো ফন্দি-ফিকির মাথায় ঘুরলে জানিও। সেই নিয়ে বিশেষ কোনো গদ্য লিখতে পারো। মণীন্দ্র গুপ্তর যা বয়েস, ওনার সঙ্গে কথা বার্তা, সংক্ষেপে হলেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মেলায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কবিতার বই নিয়ে গত বার লিখেছিলে এবং ফেসবুকে ডাইরেক্ট পোস্ট করেছিলে। এবার যদি লেখো তো শূন্যকালে দিও।“ (প্রথমে সে ৯ মার্চ ২০১৭র কথা জানায়। পরে মত পরিবর্তন করে ১৭ মার্চ করে)। পত্রিকা নিয়ে ‘ফন্দি-ফিকির’। আমি হলপ করে বলতে পারি, একথা সম্পাদক দীপঙ্করের মুখেই মানায়। আর কেউ বললে আমি ভয় পেয়ে যেতাম। কিন্তু এ যে দীপঙ্কর দত্ত! না, আর কোনওদিনই আমার ‘ফন্দি-ফিকির’ জানানো হবে না তাঁকে। জানানো হবে না, মণীন্দ্রদার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি, বন্ধু। মনটা ভারি হয়ে ওঠে। চোখে পোকা পড়ে যায়।

তরুণ নতুন কোনো কবির খোঁজ তাঁকে জানালে তৎক্ষণাৎ তার কনটাক্ট নাম্বার নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, লেখা নিয়ে পড়ে, ভালো লাগলে তাকে পত্রিকায় প্রকাশ করা, এও আমার অভিজ্ঞতায় আছে। তো, এইভাবে পত্রিকার জন্য লেগে থাকা, সময় দেওয়া, প্রায় অসম্ভবকে ধৈর্য ধরে সম্ভব করা, কবি-সাহিত্যিকের লেখা সম্পর্কিত সংশয় দোলাচলকে তার সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও নিজস্ব মতামত দেওয়ার মাধ্যমে কাটিয়ে তোলা, অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে পত্রিকার প্রেজেন্টেশন ঠিক করা এবং রূপায়িত করা, নতুন তরুণ কবি সাহিত্যিকের প্রতি যথার্থ আগ্রহ প্রকাশ করা আমি একজন সম্পাদকের বিরল গুণ বলেই মনে করি। আর মনে করি আজকের দিনে সম্পাদক-লেখকের এই মিথস্ক্রিয়া দুর্লভ। এই দুর্লভ ও বিরল গুণ দীপঙ্করের ছিল।

ব্যক্তি দীপঙ্কর নিয়ে কথা বলা ও মন্তব্য করার আগে দুটো কথা পরিস্কার করে জানাতে চাই। এক, আমার দেখা-বোঝা আর আমার সঙ্গে ইনটার‍্যাকশানে জড়ানো দীপঙ্করকেই আমি আলোকিত করার চেষ্টা করব। আমাকে বাদেও বহু মানুষের সঙ্গে তার আমার মতই বা আরও গভীর বা অগভীর সম্পর্ক যে ছিল, ছিল যে টানা-পোড়েন, যার অনেক কথাবার্তাই আমি দীপঙ্কর বাচনিক জানি, সে সম্পর্কে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করি। দুই, দীপঙ্কর সম্পর্কে আমার বলা কথায় বা মন্তব্যে কেউ আঘাত পেলে আমি দুঃখিত হব। কেননা কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য আমার এ-লেখা নয়। আর দ্বিমত তো থাকতেই পারে, তা নিয়ে কারুরই কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।

আগেই বলেছি, দীপঙ্করের সঙ্গে আমার পরিচয় ও কথাবার্তার শুরু ২০০৫-এর জানু-ফেব্রু হবে। প্রথম দু-বছরে আমাদের যোগাযোগ ছিল খুবই কম। কিন্তু ২০০৭-এর পর থেকে ওঁর প্রয়াণ অবধি যোগাযোগ ছিল প্রায় নিয়মিত। কখনো খুব বেশি, কখনো একটু পাতলা। ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে, প্রায় ২০-২২ বার (একবার কলকাতা এলে মিনিমাম দু-তিন বার আমরা মিট করেছি,বসেছি), কয়েকবার বাদে পান হয়েছে প্রায় প্রতিবার, একসঙ্গে রাত কাটিয়েছি দু-বার। সবই কলকাতায়। বইমেলায় আসার আগেই প্রতিবার সে শিডিউল জানিয়ে দিত কয়েকজনকে, তার মধ্যে আমাকেও, এবং সেভাবেই এসব। এই সময়কালের মধ্যে আমি নিজে দিল্লি গেছি দু-বার। একবার ২০১৩ সালে ‘বেঙ্গল এসোসিয়েশন’-এর ডাকে। আরেকবার এই ২০১৬ সালে দুই বন্ধুর সঙ্গে। দু-বারই তাঁকে জানিয়েছি, দু-বারই সে টেলিফোনে মেসেজে প্রতিদিন প্রতিবেলায় খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু নিজে এসে দেখা করেনি বা আড্ডা জমায়নি। কিছুটা অবাক ও হতাশ বোধ করলেও, আমার কাছে সবটাই অবাক করা ছিল না। তাঁর মতো করে হয়ত কারণও ছিল। কিন্তু সামান্য হলেও আমার অবাক-ভাবটা আমাকে কষ্টই দিয়েছে। এই দেখা-দেখির কথাবার্তা ছাড়াও নিয়মিত কথাবার্তা হত টেলিফোনে, মেসেজে, আর ফেবুর ইনবক্সে। এসবের ভিত্তিতে আমার মনে হয়েছে, দীপঙ্কর এক কবিতা নিবেদিত প্রাণ। নিজে খুব কম লিখলেও তাঁর সজাগ পাঠ আর দৃষ্টি ছিল। নিজের লেখকি ঢং ছাড়াও সে যে-কোনোরকম প্রথা বহির্ভূত কবিতাকে স্বাগত জানাতো। কবিতা নিয়েই আমাদের সম্পর্ক। বণ্ডিংও কবিতা নিয়েই। এসব নিয়ে সে খুবই পরোপকারী, অন্তত আমার রিয়েলাইজেশনে। শুধু তাঁর পত্রিকায় পাঠানো কবিতা নিয়ে আমার সংশয় বা দোলাচলেই কথা বলা মূল্যায়ণ করা নয়, আমার বিগত ৪-৫টি বই প্রকাশের আগে সে বই-এর নামকরণ প্রচ্ছদ নিয়ে তাঁর মূল্যবান মত জানিয়েছে। বারবার চালাচালিতে অসন্তুষ্ট হয়নি, এড়িয়ে যায়নি। এখানে তাঁর অকপট মনোভাব আমি লক্ষ্য করেছি। এ বিষয়ে কৃপণ ছিল না সে। জানতে চাইলে আমিও ওর শেষ বইটার নামকরণ, প্রচ্ছদ, দু-তিনটে কবিতার রাখা না-রাখা নিয়ে আমার কথা জানিয়েছি। এরকমই ছিল আমাদের বোঝাপড়া। শুধুমাত্র কবিতার কারণে কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে, এমনটা আমার জানা নেই।

দীপঙ্কর মানেই ধুন্দুমার, দীপঙ্কর মানেই উচ্ছাস, হুল্লোড়, মজা। দীপঙ্কর মানে অনেক কথা আর থেকে থেকে চিল্লানো। দীপঙ্কর মানে আবেগ, অনেক সময়ই অগ্র-পশ্চাৎ না-ভেবে কিছু করে ফেলা। দীপঙ্কর মানে অ্যাডভেঞ্চারিজম, প্রায়শই কাঁচা খিস্তি সহ যা-মনে-হয় ঠিক তাই বলা, ধানাই-পানাইহীন। দীপঙ্কর মানে পান, আরেকটু পান, পারলে আকণ্ঠ। দীপঙ্কর মানে চোখের জল, তখন শিশু। কিছু নমুনাঃ দেখা হলে জড়িয়ে ধরাতেই টের পেতাম ধুন্দুমার খানা। উচ্ছাস চেপে রাখতে পারত না, চেষ্টা করতেও দেখিনি। চটপট প্রোগ্রাম তৈরি করে ফেলত আড্ডার। আর আড্ডা মানেই কবিতা নিয়ে দাপাদাপি। সপাটে ভালোকে ভালো আর তাঁর লাগা মন্দকে মন্দ বলে জানিয়ে দিতে কোনো কসুর করতে দেখিনি। তখন বন্ধু নয়, কাছের নয়, যুক্তি দিয়ে নস্যাৎ করা, প্রয়োজনে তর্কে চিল্লানোও। পানে বসলে কিছু মিঠি খিস্তির সঙ্গে মিশে যেত কিছু কাঁচাও, হয়ত কোনো উদ্দেশ্যই নেই, তবুও। পানে কখনো-সখনো পি-এন-পি-সি-ও হতো, লাগামছাড়া নয়, নয় জিঘাংসার মনোবৃত্তি নিয়ে, মনে হয় ওতে ঠিক সুখ পেত না। আরেকটু পানে কান্না, বিষাদ, ভেতরের অনেক চাপের, অনেক অবদমনের ও অনেক কষ্টে থাকা দীপঙ্কর, সরল আর প্রাণখোলা আবার কিছুটা অবুঝ ও অবোধ বালকের মতো। লড়াই-এর ময়দানটা ওঁর কতটা আর কিভাবে কঠিন ছিল, আরও কতটা কঠিন হয়ে উঠছে, এইসব।

দীপঙ্কর মানে বৈপরীত্য। একাধারে পোস্টমডার্ণপ্রিয়তা ও মঘা-অশ্লেষা সহ তিথি-নক্ষত্রের অবস্থান নিয়ে চিন্তা ও চলা। একাধারে নব্য-প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানের ধারাকে স্বীকার, প্রয়ো্গ ও ভালোবাসা এবং ছিন্নমস্তা-চামুণ্ডা সহ পুরাণের নানাবিধ সংস্কারের প্রতি আকুলতা। দীপঙ্কর মানে একটা তামসিক ভাব। সবকিছুই বেশি বেশি। ঝাল বেশি, টক বেশি, মিষ্টি খেতো না, পান বেশি, কথা বেশি, আপাত রাগ বেশি, দ্রোহ বেশি, অভিমান বেশি, ভালোবাসা বেশি, দুঃখ বেশি, একাকীত্ব বেশি, আবার মনে হয় ঘৃণাও খুব কম নয়।

দীপঙ্কর কি আনপ্রেডিক্টেবল ছিল? ছিল তো। অস্থিরচিত্তরা খানিকটা এরকমই হয়। এক ধরণের পাগল বা হাফ-পাগল কবিদের আমি এরকম দেখেছি। আমার প্রিয় অগ্রজ কবিদের মধ্যে সুশীল ভৌমিকের এরকমটা দেখেছি। পূর্ব-অভিজ্ঞতা। আর অনুজদের মধ্যে দীপঙ্কর। এই এটা বলে সেটা করে ফেলল। এই এটা বলে কদিন পরেই ফিরিয়ে নিল কথা, বলল অন্য কথা অন্য চিন্তার কথা। আজ অমুক খুব ভালো তো, পরশু তার মতো গদ্দার হয়না। বন্ধুদের অনেকেই কি ভয়ে থাকত, কখন কি করে বসে? অন্য কারো কথা জানিনা, আমি একটু হলেও থাকতাম।

দীপঙ্কর ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না। নেহাৎ সব দোষ-গুণের মানুষ ও কবি ছিল সে। শুধুই কি দুষ্টুমি আর মজা? চপলতাসহ বদমায়েসি ছিল না? ছিল তো। আমিই একবার তাতে পীড়িত। কিছুটা দহিতও। একবার মেলায় এক বন্ধুর নানাবিধ সম্পর্কে একটা হাতেগরম মন্তব্য করার পর আমি হেসে উঠলে, আমার হাসিটাকেই ব্ল্যাকমেল করে আমার অসাক্ষাতে সেই বন্ধুকেই আমার মুখে মন্তব্যটি বসিয়ে, বলে দেয়। ব্যাস, যায় কই? সেই বন্ধু আমার ওপর খাপ্পা, আমার ওপর অভিমান করে থাকে দীর্ঘদিন। অনেক পরে সেই বন্ধুর মুখে সঠিক কথাটি শুনে যখন দীপঙ্করকে ফোন করি, তখন তাঁর খ্যাক-খ্যাক হাসির দমকে টেলিফোন প্রায় ফেটে পড়ে। এটা ঠিক, সেই হাসির মধ্যে কোনো প্রতিহিংসার আঁচ আমি পাইনি। হাসিতে ছিল, নির্মল বদমায়েসির চিহ্ন। তারওপরে সেই বন্ধু বিষয়টা রিয়েলাইজ করে ও আমি খানিকটা হলেও মুক্তি পাই।

এভাবেই এবং এরকমই দীপঙ্কর। শুনেছি ও জেনেছি অনেক বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা। কিন্তু আমার সঙ্গে এক যুগের এই সম্পর্কে তেমন আহামরি টানাপোড়েন কিছু ছিল না। তাই সহজে দীপঙ্করকে ভুলে যাওয়া আমার কাছে কঠিন ও কষ্টের। শুধু কবিতাচর্চার ক্ষেত্রেই মতামত সাহস আর ভালোবাসা পাইনি। ব্যক্তিক জীবনেও দুঃখে কষ্টে বেদনায় একাকীত্বে লড়াইয়ে সে তাঁর সাধ্যমত আমার পাশে থেকেছে, দাঁড়িয়েছে। স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর সেই দূর থেকেই আমার পাশে থাকা আমি ভুলব না, দীপঙ্কর। আমার বই-পত্তর প্রকাশের সময় তোমার সহায়তা ও প্রচার আমি ভুলব না, দীপঙ্কর। কোনো একসময় ফেসবুকে আমার বিরুদ্ধে করা একজনের অভিযোগ ও কুৎসার বিষয়ে তোমার পরামর্শ, সাপোর্ট আর প্রচার আমি ভুলব না, দীপঙ্কর। আমার অসুখে-বিসুখে বা ইদানীং-এর হাঁটুর অসুবিধায় তোমার দুষ্টিমিসহ উদ্বেগ আর হোমিও-প্যাথ প্র্যাসক্রিপশন আমি ভুলব না, দীপঙ্কর। কোনো কাজে অগ্রসর হওয়াকালে স্বেচ্ছায় তোমার দিন-ক্ষণ বিচার ও জানানো, মানি না-মানি আমি ভুলব না, দীপঙ্কর। প্রচুর তথ্যের জোগান, নানাবিধ খবর হামেশাই সরবরাহ করা, আমি ভুলব না, দীপঙ্কর। তুমি থাকবে।

কী করে ভুলি আমার কবিতা নিয়ে তোমার গঠনাত্মক সমালোচনা? লিখেছিলে— “ছোট কবিতাগুলিতে জৈবনিক অভিজ্ঞতা প্রসূত দার্শনিক কথা ঢুকেছে। পোস্টমডার্ণ গুরুবাণী। শব্দ ও ভাষার বিন্যাসে মেদহীন এক স্মার্টনেস এসেছে। অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ কবিতাগুলির মধ্যে ‘এ কবিতায় আমি’ ১,২,৩ এ যে ঝাঁঝ ও টেনশন সৃষ্টি হয়েছিলো তা পরবর্তী পর্বে ‘এ কবিতায় আমি’ রিপিটেটিভ উচ্চারণ ও উপস্থাপনায় মেলোড্রামাটিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।” বা, “পোস্টমডার্ণ আমার প্রিয় সাবজেক্ট, আপত্তিকর অর্থে ব্যবহার করিনি। পোস্টমডার্ণ গুরুবাণী বলতে— দার্শনিক তত্ত্ব-তেউরগুলি তোমার অত্যাধুনিক ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিমায় এক নতুন দিশা পেয়েছে। রিপিটেটিভ আবহ পঞ্চাশের কবিরা এমনকি শক্তিও তৈরি করেছিল কবিতায়। আজকের সময়ে তা অবসোলিট তা বলছি না। সবেরই পাঠক আছে। তবু ভেবে দেখো।” কী তরতরে গদ্য, আর কী বিশ্লেষণ। অথচ একটা পত্রিকার জন্য কবিতা বিষয়ক একটি গদ্য বারবার বলেও তোমাকে দিয়ে আমি লেখাতে পারিনি। আমি ফেল, তুমি পাস।

ফুরোবে না। কিন্তু এবারে শেষ করতে হবে। তোমার সঙ্গে আমার শেষ ইনবক্স কথনেই তা আপাতত শেষ হোক। পরে কখনও…।

৬ জানুয়ারি, ২০১৭। ০১-৪৭। তুমি—“সমস্ত রাজধানী ও দুরন্ত ট্রেন প্রায় ২৪ ঘন্টা লেট যাচ্ছে পথে কুয়াশার কারণে। বিকেল ৪-২০র ট্রেন ছাড়ছে রাত ৩ টায়। কম্বল মুড়ি দিয়ে স্টেশনে এত ঘন্টা বসে থাকলে অসুখে পড়বো। দেখার কেউ নেই। সঙ্গে কোনো বন্ধুও যাচ্ছে না। তাই লিটল ম্যাগাজিন মেলার আশা ত্যাগ করলাম। কাল এই টিকিট ক্যানসেল করে বইমেলায় যাওয়ার টিকিট কাটবো ২ ফেব্রুয়ারির। ৩-৪-৫ শেষ তিন দিন বরাবরের মতো মেলা দেখবো। ৬ তারিখ ব্যাক। টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।”
৬ জানু, ০৬-৫৬। আমি—“কী যে করো না! তাই এসো তাহলে।”
৬ তারিখ রাতেই আমি কলকাতা ছাড়ি জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে। আর কথা হয়নি। জয়ন্তী থেকে ফেরার পথে খবর। পরে ১২ জানুয়ারি, ০৯-৫১য় সেই ইনবক্সে আমি লিখি—“আর কোনও দিনই তুমি আসবে না। হায়!” Chat Conversation end.

আজ কিন্তু শেষ করব আমার টুপি খুলে রেখে, আমার জানা তোমার লড়াই, তোমার প্যাশন, তোমার ভালোবাসা আর তোমারই ধুন্দুমারের সামনে। করব প্রণামও।

3 comments:

  1. উমা দার লেখায় দিগন্ত আরো বিস্তারিত হল।মন ভরে গেল পড়ে।

    ReplyDelete
  2. খানিকটা লেখা যখন পড়ে শুনিয়েছিলে তখনই বুঝতে পেরেছিলাম কতটা প্যাশনেট ,স্বতঃস্ফূর্ত, বলিষ্ঠ , দরদী , ডেসক্রিপটিভ ,ইন্টের‍্যাক্টিভ লেখা হবে যা দীপঙ্কর দত্ত কে তিন রকম ভাবেই আত্মস্ত করাবে । চলমান আবেগের স্রোতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে সমস্ত বিষয়বস্তু । ইচ্ছে করছে দীপঙ্কর দত্তকেই পড়ে শুনাই। It touches the cockles of my heart .Described the rawness of the spirit of Dipankar datta in such a sensual way with all rich elements and by the great creative upliftment .so honest piece .As usual your writing skill and the attachment of such linear bonding that amidst a dead silence have been intimated . great salute.

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল লাগল লেখাটা

    ReplyDelete

Facebook Comments