ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা -১
দেবযানী বসু
স্বভাবে ডায়াস্পোরিক কবি দীপঙ্কর দত্তের যে কোনো একটি কবিতার রসাস্বাদন করে কবির মূল চেতনাভূমিতে পৌঁছনো যাবে। 'প্যাসেজ' নামক একটা কবিতা তুলে নিলাম। আতশকাঁচ ছাড়া এ কবিতার লোকেশানে পৌঁছন অসম্ভব। প্যাসেজের অগোছালো বিহ্বল অবস্থাটি মস্তিষ্কের স্বপ্নময় বাস্তবরহিত লোকজগৎ ।
কবি শুধু একটি মুহুর্তকে ধরতে চান। সারাজীবনই পরীক্ষা নিরীক্ষার কবিতা লিখেছেন অর্থাৎ ভাষা ও ভাবের হাজারো মুখ ও পন্থা খুলে দেবার সাধনা। শুধু বাংলা ভাষা নয়, ইংরাজি হিন্দি পাঞ্জাবী, সংস্কৃত, নানাবিধ অপশব্দ কবিতার শরীর তৈরি করেছে। বিবিধ ভাষার সুষম মিশ্রণ আবার কোথাও আছে কবি কালিদাসের কাব্যের ব্যবহৃত শব্দ, বাংলার আঞ্চলিক শব্দ এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের রহস্যময়তা মাখানো শব্দ ও পাই।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা -২
ব্লেডের জোখিম নেবার স্পর্ধায় তমসা থেকে জ্যোতির্ময়তার দিকে যাবার আকাঙ্খায় আত্মহননের বিপরীতে উড়ানের তীব্রতায় ঝলসে উঠেছেন বারবার। জোখিম অর্থাৎ পাঙ্গা নেবার ক্ষমতা।পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা।
'ডিফথং' শব্দটি আসে পারিপার্শিক অবস্থা যা স্বরবর্ণের দ্বৈত অবস্থান বোঝাতে। পরিবেশ সবসময় পারিপার্শিক অথচ গ্লাইডিং ভেসে যাবার মিশ্রিত আবেদন যা সঙ্গীত জগতের উপাদান অথবা যা একই সঙ্গে কোনো সমস্যার উপশম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। মানুষ তো নিরাময় চায়। আশ্রয় চায়। পোতাশ্রয় নামে কবির একটা কবিতা আছে যেখানে 'জাহাজের ডিফথং' ,'মায়েদের ডিফথং' এরকম প্রয়োগ দেখা যায়। আমাদের জীবনের বিলম্বিত লয় যেন ডিফথং এর উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। একটি সাধারণ জীবনবোধ ও বোধির জগৎ কে যা টেনে দীর্ঘায়িত ও মূল্যবান করে।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা -৩
'ব্লেডের জোখিম নিচ্ছি ফের প্যাসেজ ডিফথংয়ে / দালানের ব্যাক-আপ কাছিয়ে এসে এই শব্দার্থের একটা অচেনা মুহূর্ত এসে কেড়ে নিয়ে যায় আমাদের স্থিতাবস্থা। মনে হয় বারুদবদ্ধ প্রতিটি জীবন। কবিও পাঠককে ঝটকা দেন প্রচলিত ভাষার ঘিষাপিটা অর্থ থেকে নতুন দুনিয়া গড়ার। কবি বলছেন - 'অনাদি কাল থেকে পাখি পড়ানো ঝিনুকে গেলানো শব্দের ঘিষাপিটা অর্থ ও আপনার কবিতার শব্দার্থের হরিহর আত্মা ক্রমাগত মেটান্যারেটিভের জন্ম দিয়ে যাক সে কথা বলছি না'।
মেটান্যারেটিভ থেকে দূরে বসতি গড়বার দুর্বার ইচ্ছেয় জন্ম নিচ্ছে একের পর এক ক্ষুরধার উজ্জল কবিতার পঙক্তি- দালানের ও প্যাসেজের বাস্তুতন্ত্র মানচিত্র এঁকে বদ্ধ চৌহদ্দি থেকে পালাতে চেয়েছেন। চিত্রনাট্য বানানোতে সফল কবি।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা- ৪
কবির কবিতায় আছে গতি। অনবরত গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে পৃথিবী ও সমাজের সবটুকু বিপরিতার্থক ক্লেদ, নিচতা, প্রেম মেপে নিতে চান। আবহ থেকে আবহান্তরে ঘুরে কবি নিজেই যোদ্ধা, কোথাও না কোথাও তিনি ক্যাপ্টেন, পাইলট, মাঝি, নাবিক হয়ে আছেন - 'ঝাঁঝ ধোঁবার হাভাত গিলছে বুলেটে ছল্লি ছল্লি এই জ্যাকেট / সমস্ত ভার নিয়ে প্যাডেলে দাঁড়িয়ে পড়েছি/ স্টেপনি ঘুরছে না'।
দৃশ্যময়তার অস্থিরতা। সিনেমার সিকোয়েন্স চেঞ্জ করার মত। সংলাপ প্রয়োগে তা আরো উজ্জল জীবন্ত। নিজেই মুখ্যচরিত্র ও পার্শ্বচরিত্রের হয়ে কথোপকথন করছেন। তবে এই দ্বৈতালাপ ভারবাহী হয়ে থাকে না।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা - ৫
কবিতা লবঙ্গলতা হয়ে থাকে না। মেজাজেই তিনি স্বতন্ত্র। বিশাল নক্সীকাঁথা বোনা তার লক্ষ্য নয় - 'স্ট্যান্ড করিয়ে বলি তুই দাঁড়া একটু দম নে আমি দেখছি / যদি না ফিরি, এ দেয়ালমুখো তোর সামনে পুব/আর এই বামহাতি উত্তুরে পথ গেছে বাইরে ,চৌরাহায়'।
গা ছমছমে কবিতা। ঘস্ট , হরর, ডিটেকটিভ ফিল্মের কথা মনে পড়বে ।
যারা বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে এসেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে, যে কবি যত বেশি চড়াই উৎরাই ভেঙেছেন বিভিন্ন ভাষার তারা জানেন প্রত্যেকটি ভাষাই কতো দামি প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মত। ভাষা আয়ত্ত করার পরে আসে লীলাকলমের সৌরভ।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা - ৬
সমাজের সর্বস্তরে ব্যবহৃত শব্দ্গুলি একটি সবল দস্তানার মত কবিতায় আশ্রয় পেতে ঢুকে পড়েছে। 'শাবলের ঘায়ে যে কটা শার্শি ফাটে/আলোর ঝাঁঝরি ধ্বক এসে লাখো কারসরে/ ছড়িয়ে পড়ছে নোডাল মোৎসার্ট' - ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস, টোটা ইত্যাদি কবিতায় ও আছে শাবল শব্দটার ব্যবহার। শাবল কাজে লাগে কাদের অথবা কিভাবে কাজে লাগে সে চিন্তায় যাচ্ছি না কবির হাতে সহস্র অস্ত্র থাকে, থাকে অশুভকে ভাঙবার ইঙ্গিত। ঘায়ে শার্শি ঝাঁঝরি ধ্বক এই কটি শব্দ মিলে প্রবল কল্লোল সৃষ্টি করে কবিতাটির আবহমন্ডলে। মোৎসার্টের গান ,তার মিউজিক এসে বৈদ্যুতিক শিহরণ সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের অসংখ্য কেন্দ্র তাদের শাখা প্রশাখা মেলে তরঙ্গ বাজায়।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা -৭
আমরা জানি উলফগ্যাং আমেদিউস মোযার্ট এর কাজের ভিতর আছে ' supreme expression of suffering and terror, there is something shockingly voluptuous ' সংগীতেই আছে যাবতীয় মানসিক ক্লেশের মতামত উত্তরণ।
কবির ক্রমশ ক্ষোভ জ্বলন সব সুরের তরল আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার কাব্যময় উৎসার পরবর্তী লাইনগুলি। এবং এতে গোটা হাসপাতালটির অস্তিত্ব মুছে যাচ্ছে। কবি দীপঙ্কর দত্তের অনুভুতির ক্লাইম্যাক্স ও পার্গেসন পাঠকের অন্তরেও সঞ্চারিত হচ্ছে।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা - ৮
সবশেষে পড়ে নেব প্যাসেজ কবিতার শেষাংশ যা সত্তর মিমি বিশাল অতা নিয়ে অগ্নিদৃশ্য রচনা করেছে।'জ্যাকেটের একলিপ্স শেষ হলে ল্যাংটা দেওয়ালে পিঠ লড়ি একা/ দেখি আগুনে জ্বলছে সে আর ঝাপটাচ্ছে দু'পাশের প্যাডেল/ স্পোকে ফেটে ফেটে তাজা শাঁস ছেৎরে যাচ্ছে দেওয়ালে দেওয়ালে/ জ্বলন্ত টায়ার থেকে আগুনের আঠালো বাবল উড়তে উড়তে ক্রমে/ ধরে যাচ্ছে রিসেপসন,থিয়েটার,আই সি য়ু,ল্যাবোরেটরি,/ ব্লাডব্যাংক,বার্ন্স ওয়ার্ড,ক্যান্সার ওয়ার্ড -
হাংরি আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ,পোস্টমডার্ন টেকনোলজি আক্রান্ত কবি দীপঙ্কর দত্ত তার তরুণ তুর্কি মেজাজটা কবিতায় চারিয়ে দিয়েছেন ।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা - ৮
সবশেষে পড়ে নেব প্যাসেজ কবিতার শেষাংশ যা সত্তর মিমি বিশাল অতা নিয়ে অগ্নিদৃশ্য রচনা করেছে।'জ্যাকেটের একলিপ্স শেষ হলে ল্যাংটা দেওয়ালে পিঠ লড়ি একা/ দেখি আগুনে জ্বলছে সে আর ঝাপটাচ্ছে দু'পাশের প্যাডেল/ স্পোকে ফেটে ফেটে তাজা শাঁস ছেৎরে যাচ্ছে দেওয়ালে দেওয়ালে/ জ্বলন্ত টায়ার থেকে আগুনের আঠালো বাবল উড়তে উড়তে ক্রমে/ ধরে যাচ্ছে রিসেপসন,থিয়েটার,আই সি য়ু,ল্যাবোরেটরি,/ ব্লাডব্যাংক,বার্ন্স ওয়ার্ড,ক্যান্সার ওয়ার্ড -
হাংরি আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ,পোস্টমডার্ন টেকনোলজি আক্রান্ত কবি দীপঙ্কর দত্ত তার তরুণ তুর্কি মেজাজটা কবিতায় চারিয়ে দিয়েছেন ।
ট্রপিকাল দীপঙ্করের রৌদ্রমুখিনতা - ৯
অবশ্য পরবর্তী সময়ের কবি হবার সূত্রে পেয়েছি দীপঙ্কর দত্তর সমমনস্ক কবিদের যারা হলেন ধীমান চক্রবর্তী , অলোক বিশ্বাস, জহর সেন মজুমদার প্রমুখ আরো অনেক কবিদের কাব্যশস্য।
অন্তস্তলের জটিলতা কবিকে দিয়েছে বক্রভাষাবিন্যাস। কাব্যবোধ ব্যঙ্গ প্রবণতার সঙ্গে হৃদয়হীন ভাষাচর্চা নয়। তার হাইটেনসন তারের আবেগ পাঠককে দোলা দেয় দেয়। এখানেই তিনি সার্থক।
No comments:
Post a Comment