রঞ্জন মৈত্র

 

জাগলারের আগ্নেয় বসন্ত

রঞ্জন মৈত্র  

 গত কিছুকাল, আসলে শূন্যকাল আন্তর্জালিক পত্রিকাটি বেরোবার পর থেকে মাঝে মাঝেই ফোন আসতো কিম্বা মেসেজ, "দুটো দমদার প্রেমের কবিতা পাঠিয়ে দাও তো। অমুক তারিখে এতটার সময়ে গ্রহনক্ষত্রের এই এই শুভ সমাবেশ। তাই ওই সময়েই শূন্যকাল প্রকাশ করবো। দেরী কোরো না"। ফোন বা মেসেজ, দীপঙ্কর দত্তর। আসলে অনেককাল আগে একবার আমি বলেছিলাম যে, দীপঙ্কর, তোমাদের ( তোমাদের বলতে দীপঙ্কর-অরূপ চৌধুরী ) কবিতা জুড়ে আগাগোড়া আক্রমণ-আগুন- উদ্দাম চীৎকার - বিস্ফোরন- কালি ক্লেদ- তীব্র শ্লেষ- একটানা এরকমই বরাবর, কেন? এই যে এতদিন বেঁচে আছ, এই যে নিজেদের খুশীমত জীবন এবং কবিতা যাপন করছো, তার কোথাও কি কোন ভালবাসা মায়ামমতা পরার্থপরতা এসব চোখে পড়েনি কোথাও! এমনকি নিত্যদিনের চারপাশের যেসব মানুষদের, ঘরের মানুষদের শারীরিক এবং মানসিক সহায়তা না পেলে তোমাদের এই যাপন সম্ভবই হ'ত না, তাদের ভালবাসাও কলম খুললেই হারিয়ে যায় কেন তোমাদের নজর থেকে? অথবা উহ্য ক'রে দাও, কেন? কিচ্ছু উত্তর দেয় নি দীপঙ্কর। হয়তো আমার প্রশ্নটাই ভুলভাল ছিল, বুঝি নি আমি ওদের কবিতা। কিন্তু সম্ভত ওই কারনেই পরবর্তীতে আমার কাছে লেখা চাইতে হ'লেই মজা কোরে বলতো, প্রেমের কবিতা পাঠিয়ে দাও। অথচ কি অমলিন এই পথ পরিক্রমা, কি গভীর বন্ধনে এই দীপঙ্কর-অরূপ, সেই জিরো আওয়ার পত্রিকার শুরু থেকে, সে আজ কতকাল! আরও অনেকে ছিলেন, তাঁদেরকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে বলি, তবুও ওই দুজনই ছিলো দিল্লীর সম্পূর্ণ অন্য ভাষাভঙ্গীর বিষ্ফোরক বাংলা কবিতার সত্যিকার মুখ, অন্তত বাংলা কবিতা-চর্চার পৃথিবীর কাছে। একটু ঝুঁকি নিয়েই বলি, কোন জায়গা থেকে একটি পত্রিকা করা, তার প্রচার করা এবং নানা মেলায় অংশগ্রহণ করা, নানা লেখকের লেখা অন্তর্ভূক্ত করা আর কোন একটি জায়গার কবিতাচর্চার মুখ হয়ে ওঠা, প্রতিনিধি হয়ে ওঠা সম্ভবত ভিন্ন ব্যাপার। জোড়ামুখ প্রকৃতপক্ষে। দীপঙ্করের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের ( যেটুকু চিনেছি আমার সামান্য ক্ষমতায়) মৃদুভাষী স্বল্পভাষী ফিজিক্যাল হুল্লোড় বেশি-না-করতে-পারা অরূপকে আমি দীপঙ্করের থেকে আলাদা ক'রে কিম্বা অরূপের থেকে দীপঙ্করকে আলাদা ক'রে ভাবতে পারি না আজও। তো আজ শুধু দীপঙ্কর।

কথাবার্তায় পুরো ঠোঁটকাটা অনর্গল( ফলাফলের তোয়াক্কা না ক'রেই ), এবং কবিতায় আগুনখোর, কবিতার ভাষায় অনায়াসে বেসংযমী, অশৃংখল, নাশালীন, সবকিছুকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া ভঙ্গীর এই দীপঙ্কর দত্ত--- যে কিনা চর্চা করা হস্তরেখাবিদ, গ্রহ নক্ষত্রের সু এবং কু প্রভাবে প্রবল বিশ্বাসী এবং অন্যদেরকে সেইমত রত্ন-পাথরের পরামর্শও দিয়ে থাকে শুনেছি, যে কিনা হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার সিরিয়াস চর্চাকারী এবং অন্যদেরকে প্রয়োজনমতো ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয় এমনকি নেট থেকে সেই ওষুধের কার্য্য এবং কারিতার বিবরণ পাঠিয়ে দেয় রাতারাতি, যে কিনা সামান্য অভিমান কিম্বা ভুল বোঝার সূত্রে বন্ধুদের সুন্দর কবিতা-জমায়েতকে তছনছ ক'রে দিয়ে বেরিয়ে চলে যেতে পারে অক্লেশে, যে কিনা শেয়ার মার্কেটের একজন শিক্ষিত অভিজ্ঞ চর্চাকারী এবং পরামর্শদাতা, আর যে কিনা মা বলতে অজ্ঞান, নিজের মা ছিল যার সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা, সেই দীপঙ্কর দত্ত, কলম খুললেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠাই ছিল যার অভীষ্ট এবং নিয়তি। একজীবনে এই ভীষন সব বৈপরীত্য একই শরীরে এবং মগজে দীর্ঘদিন ধারণ করা প্রকৃতপক্ষেই আগুন ধারণ করা এবং তার নিত্য দহনের যেমত ফলাফল। আর নিত্য প্রতিভা ও অস্থিরতার তাড়নায় পুড়ে যাওয়া একটা মূলত সরল ভালমানুষ কিঞ্চিৎ পাগলাটে ও ধ্বংসকারী এবং প্রয়োজন পড়লেই পরোপকারী এক জুবকের তিল তিল করে পুড়ে যাওয়ার কাহিনী। এই-ই দীপঙ্কর, আমার ভুল বা ঠিক বোঝায়। তাই তার রচিত কবিতার পাতার ওপর শান্ত মনে উপুড় হয়ে পড়লে, অজান্তে লালিত এই মারাত্মক জটিলতার ছ্যাকা লাগে, লাগবেই।আত্মধ্বংসের বীজ তার রক্তে, মানসগত সমস্ত জটিলতার জাল তাকে জাপ্টে রাখে, স্থির থাকতে দেয় না মুহুর্তও, আর তার সমস্ত কবিতার রসদ ও উৎসমুখ ন্সেইখানেই। নিজেকে সবখান থেকে বিচ্ছিন্ন একলা করার, তা উপভোগ করার ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গী আর মনের খুব গোপনে একজন প্রকৃত সঙ্গী একটি প্রকৃত ভালবাসার চাহতে মরে থাকা এই যুবক, দীপঙ্কর, একটু তার কবিতায় যাই----

"কয়েক মুহুর্ত শুধু, আরবার,
গার্হপত্য আগুন ঢুকছে বাজার-চবুৎরা আর এক ভলভো ফিরছে
গ্যাংস অব কালিয়াচক বসিরহাট ভায়া ওয়াপসিপুর -
একটির পর একটি ঝরে পড়া সিলসিলেদার সেলাই কলের মহার্ঘ কালীনগুলি
আজ দগ্ধ বিবর্ণ
রাজমা ও কিডনির কলামকারি একেকটি গ্লোমেরুলাসের শর্ট সার্কিট চিবোতে
আমাদের কোনো কেচাপ লাগে না
রাত্রি তিনটেয় ফ্লাডগেট ভেঙে আগুনের অনর্গল দাউ আর লপেট কাম্ অন্
আগে চুল খুলে একবার হেঁটে দেখাও দিকি মা
রোবীন্দ্রোশোঙ্গীৎফোঙ্গীৎ পরে হবে খন" -------


কিডনিতে ছড়ানো সরু কৈশিক নালীর জটাজাল, ওই গ্লোমেরুলাস, যা আসলে এক ছাঁকনিও বটে ভাল মন্দের, ওই তার উচ্চারনের উৎসস্থল , তার উদগীরণের।আর তাকেই সে চিবিয়ে ছিবড়ে করতে চায় কোন সুস্বাদক ছাড়াই আর ভঙ্গীটি হোল, কাম অন, চুল খুলে হাঁট, সঙ্গীত ফঙ্গীত পরে হবে খন। এই তার আত্মধ্বংসের, কবিতাকারি এবং উপভোগের প্যানরমিক ছ্যাকা।এইই, দীপঙ্কর।

'নতুন কবিতা' নামধারী আমাদের চর্চাধারা তার পছন্দের বিষয় ছিল না।কঠোর সমালোচনা করেছে অসংযমী ভাষাতেও,লুকিয়ে নয়,  প্রকাশ্যে, ওপন ফোরামে।তার কবিতা নিয়ে অনেক অস্বস্তি ছিল আমারও। বলেছি।বোঝাতে পারি নি।লিখিত, মুখিতও--- ছাড় দিত না কক্ষনো আর ভীষন ভালবাসতো আমাদের অনেককেই। অন্য কারও ওকে পাঠানো কত মেসেজ ফরোয়ার্ড করেছে আমাকে।পড়ে বুঝতাম ওইসব মেসেজ অন্যদের নামে করা কিন্তু তা দীপঙ্করকেও ক্ষতবিক্ষত করেছে আর সে যন্ত্রণাটা শেয়ার করতে চাইছে খাঁটি ছেলেমানুষের পদ্ধতিতে

তখন কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আমি।কোন একটি কারণে একবার কফি হাউসে দীপঙ্কর আমাকে "তোমার এতবড় সাহস--" দিয়ে শুরু করে শুধু মারতে বাকি রাখে।নিজেকে শান্ত রাখি।পরবর্তীতে ওর চাহিদা মেনে কাজ ক'রে বেশ কিছু লোকের গালি খাই। আর দীপঙ্কর দিল্লী থেকে চিঠি লেখে, তুমি বা আমি নিজেদের বিশ্বাসে অটল থাকবো, দুজনে দুজনের চিন্তাভাবনাকে নেগেট ক'রবো, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয়। পরবর্তী বইমেলায় বগলে ভডকার বোতল নিয়ে সারা মেলা আমাকে খুঁজে বেড়াতে থাকে, দেখা হ'তে প্রভূত খিস্তি সহযোগে ভডকা খাওয়ায় এবং আমাকে খাওয়াতে পেরে শিশুর আনন্দে নাচতে থাকে।এবং বারবার চাওয়া সত্ত্বেও আমাদের পত্রিকার জন্য লেখা দেয় না।আর একটু কবিতায় যাই, দীপঙ্করের------

"উত্তরায়ণের পথে সূর্যের টেস্ট ড্রাইভ
লহর লহর খেতি আদ্যাশক্তি খিলখিলা হরিৎ শস্যের মহামায়া
ঘাসে ঘাসে বর্গী এলো শিশিরের চন্দ্রবিন্দু
ছাতিমের ঝাঁজ মশলার উলাললাল্লা বিন্দু
সুদেষ্ণার বমি দেখে নবৌঠান আটখানা শশব্যাস্ত

দিন যায় মাস গড়ায় অমৃতলালের বীজ ফেঁপেফেঁপে ওঠে
জলসা জতুগৃহের গালা খুলুখুলু ঘুঙুর লিপট যায় হেঁসেল
দেয়ালে, আমি হ্যাচারিতে ডিম গুনি, মা মুরগীদের
কনগ্রাচুলেট করি, রোদ্দুরে পুর্জা পুর্জা রাইফেল খুলে
ফেলে কার্বন সাফ করি, কিন্তু স্টোভটা ছুঁই না। আমি
জানি বাদুড়রা এখন সক্রিয় ফলে বার্ণারে জ্বালানীর
উৎস্রোত অনেকটাই আধিদৈবিক

সুদেষ্ণা জ্বলছে, রোজ জ্বলে থার্ড ডিগ্রী বিপন্ন তুষকর্ণিকা"


নিজের ভিতরে হুল্লোড় তোলা জন্মবীজ, এবং মৃত্যু-ছররা, ঘুঙুর আর কার্বন আর নিজেরই রান্নার আগুন জ্বালানো থেকে দূরে থাকার উদাসীনতা এবং সুদেষনা নামক বয়লার এই সবের মধ্যে দাঁড়িয়ে সবটুকুকেই চেটেপুটে খায় দীপঙ্কর এবং তার অর্জিত সূর্য। হাঃ হাঃ হাসিটুকু উহ্য থাকে অক্ষরের স্রোতে।

এবং আমার সংগে তার দু-এক মেসেজ চালাচালি-----

১৭/৭/২০১৬

দীপঙ্কর-----   দীপঙ্করঃ  তুমি কি কবিতা লেখার সময় ড্রিঙ্ক করো?
                স্বর্ণায়ু মৈত্রঃ  ড্রিঙ্ক ক'রে কোনদিন কবিতা লিখি না আমি
                     দীপঙ্করঃ  ট্রাই কোরো, ভেতরের অনেক কথা অকপটে
                                    নির্ভয়ে বেরুবে, তিনটে লার্জ যথেষ্ট
                স্বর্ণায়ু মৈত্রঃ  সেটা ঠিক, একবার ভাং খেয়ে কয়েকটা কবিতা
                                    লিখেছিলাম, কিন্তু  ভাঙের নেশাতে
                                    সব ড্রেনে ফেলে দিয়েছিলাম।
                     দীপঙ্করঃ  আমি মাঝে মাঝে ভাং খাই। কিন্তু খুব উদাস
                                   হয়ে যাই। কবিতা লিখতে  পারি না। ড্রিঙ্ক করলে
                                   কবিতার লাইন ভীড় ক'রে আসে
                       স্বর্ণায়ুঃ  হাঃ হাঃ হাঃ
আমি-------  হা হা হা। এই দারু কা বেলায় আমি লিখেছিনু,
               একটি কবিতা আমি লিখেছিনু
দীপঙ্কর----  জীও

২৪/৭/২০১৬

দীপঙ্করঃ   প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল কচ্ছপের মাংস খাই না। মা অমৃত রাঁধতেন। আগে শীতকালে বাড়িতে ছুটির দিনে কিলো তিনেক কাউঠ্যা রান্না হ'লে মা বাবাকে দিয়ে কিছু কাউঠ্যা-রসিক আত্মীয় ও বন্ধুদের বাড়ি রান্না পাঠাতেন। আমি সংগে যেতাম। সেইসব বাড়িতে বসে কচ্ছপের মাংস পাওয়ার ও খাওয়ার অনির্বচনীয় আনন্দ ভুলবো না। সে সব দিন, মানুষজন, উৎসাহ-- সব হারিয়ে গেছে।ইছাপুরে নাকি খুব পাওয়া যায়!
আমিঃ  আজকাল অনেকদিন একেবারেই পাওয়া যায় না ইছাপুরে। আমার বাড়িতে কদাচিৎ হয়েছে, মনেও পড়ে না।কখনও তোর রান্নায় খাবো ওটা, এই স্বপ্ন রেখে দিলাম।
দীপঙ্করঃ নতুন কবিতা-র পক্ষ থেকে একটা বনভোজন কাম কবি সম্মেলন করো দু'দিনের। কলকাতার কাছে পিঠে কোথাও।
আমিঃ  মন্দ বলিস নি, কিন্তু উড়ে-টা তো ইদানীং কন্নড় হয়ে গেছে। ওকে পাওয়াই মুসকিল।
দীপঙ্করঃ  কান পকড়কে কন্নড়কে বাংলায় প্রতিস্থাপন করতে হবে
আমিঃ ঠিক ঠিক

৩১/৭/২০১৬


দীপঙ্করঃ 'খাণ্ডব' কবিতাটা শূন্যকাল-এর আগস্ট সংখ্যার জন্য লেখা। আপাতত একটাই হয়েছে ঈশ্বরানুগ্রহে।
আমিঃ  ১৫ তারিখের মধ্যে আমারটা পাঠা। না করতে নেই বাপ।
দীপঙ্করঃ ঠিক আছে। আমার লেখার ফ্লো একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, তবু চেষ্টা করছি।

০৩/৮/২০১৬

Prevention of Dengue fever with Homoeopathy: Eupatorium perfoliatum-200 ( ৫ ফোঁটা ডোজ ) দিনে ২বার ( সকাল-সন্ধ্যা ) ৩দিন খালি পেটে খেয়ে তারপর ৩-৪দিন পরপর দিনে এক ডোজ খেয়ে যেতে হবে যতদিন না ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে।

এই দীপঙ্করের প্রেমে আমি ম'রে থাকি। এই দীপঙ্করকে পুরোটা ধরতে পারি না, অক্ষমতায়। তার বহু কবিতার সামনে হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ভেবলে এবং ভালবেসে।

3 comments:

  1. লেখাটা পড়ে অনেক কিছু মনে পড়ল । উনি বলতেন ড্রিঙ্ক না করে লেখলে নাকি লেখার অপমান হয়। non-linear ,distort lekha hoy .তাই conscious mind কে সরিয়ে লিখতে হলে ড্রিংক করতে হয় ,না হলে ভাষা ভাঙে ...ইত্যাদি । অনেক সুন্দর লেখা পড়ালেন । ভাল লাগলো খুব।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ নিলীমা। হ্যা, অনেকে একটা ঘোরের মধ্যে লেখায় বিশ্বাস করেন। যেমন দীপঙ্কর করতো।

    ReplyDelete

Facebook Comments