রমিত দে



ডায়াস্পোরা ও হাইব্রিডাইজেশনে নিরিখে একটি বাকবদ্ধ জীবনপাঠ

 

রমিত দে 



  
“Dead people receive more flowers than the living ones because the regret is stronger than gratitude”…

না, এখন অনুতাপের চেয়েও বড় কথা হল মৃত্যুর পর একজন শিল্পীর ছেড়ে যাওয়া কাজ নিয়ে আলোচনায় কতটা মরালিটি আছে সে সম্পর্কে আমি আজও সমান সন্দিহান। তা কখনই নিক্তিনিরপেক্ষ নয়। সেখানে শাস্ত্রীয়তা থাকলেও সন্ধান সম্পূর্ন হয়না। হতে পারে না।আমাদের উচিত ছিল জীবিত অবস্থায় দীপঙ্কর দত্তের কবিতা নিয়ে আলোচনা, ব্যক্তিগত বোধের জায়গাগুলো তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া এবং তাঁর কবিতায় নিলীন চেতনিক ডেমোগ্রাফি উদ্ধারের কাজটা করা। কিন্তু আমরা তা করিনি । অভাব থেকে গেছে । এবং সে অর্থে শেষঅস্তক আমরা সবাই আজও মিথ্যের বেসাতিতেই মজ়ে রইলাম। ঠিক যা বাংলা কবিতার চলতি প্রথা, যেখানে ভ্রমাত্বক জগতোদ্ধারই হয়ে ওঠে কাব্যিক রূপ-অরূপের বয়ন কুশলতা। কিন্তু যিনি অরূপকে ধরতে চাইলেন না অতীন্দ্রীয়কে বিশ্বাস করতে চাইলেন না তার পাঠে এসে আমরা হোঁচট খাই, উঠে আসে সময়, লগ্ন এক সমকালীনতা, ঠিক এটাই  দীপংকর দত্ত, যাঁর কবিতার আগে কোনো প্রিফিক্স হয়না । অর্থাৎ তাঁর কবিতাকে পড়তে গেলে তাঁর সময়কে পড়তে হবে, কথা বলতে হবে ,কবিতার কোনো আদি-অভিজ্ঞতা বা পুনরনুষ্ঠানকে পিছিয়ে দিয়ে এগিয়ে আনতে হবে তাঁর ছেড়ে যাওয়া কালচারাল সিগনিফায়ারগুলোকে । আবার আশ্চর্যভাবে এখানেও কিন্তু নেই নেই করে একটা প্রিফিক্স আছে একজন মাইগ্রেটরি ইন্ডিভিজুয়াল একটি উচ্ছেদিত মূল যা ভাষামানুষ খুঁজে মরে। এই ডায়াস্পোরা থেকেই কি উঠে আসে স্ব-কে টেরিটোরিয়ালাইজ করে তোলার যাবতীয় গমন অভিগমন? যা শেষমেশ চিহ্নিত হবে আত্মগ্লানি কিংবা অক্ষমতা নামের বাকশস্যে ? যেখানে দাঁড়িয়ে দীপংকর দত্ত নাম্নী কেউ একজন লিখে ফেলবেন –“ দরোজা বলে কিছু নেই। ঘড়ির বিন্যাস ভেঙে উত্থিত দোলো লাশ বিকৃত জঙ্ঘার খিলান ছুঁয়ে রোদ রৌদ্র হ্যাভারস্যাকগুলি ধৃত ইতিহাস ঝরে পড়ে প্রাকারে পরিখায় বাতাসের দ্বিতীয়ক ঝাপটে ভোজের উদ্বৃত্ত মুর্গা শকুন মাংস ছালছোল বিষ্ঠা বদবু পরিদর্শনে এসে দ্যাখো খামার জ্বলছে ক্ষেত আধপোড়া ভাইপার যেনো জায়মান খাক নিয়ে ছাটায় দাপড়ায় ফুৎকারে লাশ কেঁপে ওঠো কিছুক্ষণ কিছুকাল –“ ! ডায়াস্পোরিক কমন কোড মেনে এ পর্যন্ত হয়ত ঠিকই ছিল কিন্তু এর পর তিনি যা বললেন- “ অ্যাম সরি, জানি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে, কিন্তু স্যার, উস্কানিটা আমি এভাবেই দেই এবং দেবো কারন আঘাত বলতে বুঝি Death blow, Coup de grace”- ঠিক এখান থেকেই ডায়াস্পোরার মধ্যবর্তী ডিসিপ্লিন অফ হিস্ট্রির জগদ্দল ব্যকরণে বিরোধাভাসের মত ঢুকিয়ে দিলেন একটি শিফটিং মেকানিজম একটি কাউন্টার ব্লো যেখানে প্রিটেনশনহীন ভাষায় কবিতা হয়ে উঠল ভ্যারাইটি অফ ভয়েস এড্রেসিং দ্য অডিয়েন্স। ডায়াস্পোরিক লিটেরেচারের স্বাভাবিক সাইক্লিকাল পারসেপশনে মধ্যে ঢুকে পড়ল একটি অনন্য লিনিয়ার পারসেপশনও। যেন একটা তীরকে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে তাক করে রাখা হয়েছে যার মাঝে বর্তমান এবং সেটাই রিচুয়াল ভিউ বা অংশগ্রহণকারী ধারনা, বাকিটা কেবল একটা ট্রান্সমিটেড মার্কার যা একটি নতুন সীমা নতুন সম্ভাবনা নতুন স্বদেশের জরিপ করতে বেড়িয়েছে। এ জগত তাঁর নিজস্ব। একেবারেই তাঁর নিজস্ব যার ধরতাই শব্দবন্ধের দিকে পিঠ করে বসে রয়েছে বাংলা কবিতার নিয়ম।  ফলে সেদিনও তাঁর এস্টাবিলশমেন্টে তিনি একক ছিলেন এবং এ মুহুর্তেও তিনি একক ? অথচ তাঁর ছেড়ে যাওয়া স্পেক্ট্রামে ঢুকলেই বোঝা যাবে তা থেকে নিষ্ক্রমণ সম্ভব না এবং কোথাও কখন যেন আমরা ডায়াস্পোরিক ঐক্য হিসেবে সংশ্লিষ্ট হয়ে চলেছি ক্রমশ।

এই যে ট্রান্সকালচার এলিমেন্টের খেলা সেখানে কিন্তু কখনই মনে হয়না এগুলো কেবল আমদানী শব্দ, কোনো গলাবাজির চেতনা, কোনো মাইগ্রেটেড অনুশাসনে জর্জরিত কবিতা। যাপনের একধরনের ডিসপ্লেসমেন্ট এবং রিলোকেশন একইসাথে ভেসে ওঠে দীপংকর দত্তর কবিতায়। ডায়াস্পোরিক ল্যাংগুয়েজের মূল ন্যারেটিভটাই যে কেবল ফেলে আসা শব্দ নিয়ে নিরীক্ষা নয় বরং কোথাও তা নতুন মাইনরিটি ডিসকোর্সকে কবিতার কাউন্টার কালচারে পরিনত করা সেটাই ছিল তাঁর নিজের সাথে নিজের লড়ার কৌশল। একজন বাঙ্গালী কবি যার চোখের ঘুলঘুলি মগজের ঘিলু কিংবা চামড়ার ঢেলায় আপাদমস্তক বাঙ্গালী  ঘোঁতঘোঁত, আর তারই মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা হরিয়ানভী গোঙানী –এখানে দাঁড়িয়ে সত্যকে মেনে এবং বাস্তবকে স্বীকার করে ঠিক কি কবিতা লেখা যায় , লেখা যেতে পারে সেটাই ছিল দীপংকার দার কাব্যিক আখ্যান এবং দর্শনও। এবং এখানেই দীপংকর দত্ত আলাদা, নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্ধী, তাঁকে নকল করা যায়না কারণ তিনি কবিতার সেই ‘অদ্ভুত নকল ভাষা’ রপ্তই করতে চাননি। কাব্যিক অ্যাকাডেমিশিয়ানদের বাইরে একটি উপভাষা তৈরী করে ফেলেছিলেন দীপংকর দত্ত। যেখানে কবিতাকে কবিতা দিয়ে আর ভ্যাঙানো যাবে না। এবং এই পুরো ব্যাপারটার ব্যপ্তি এত বড় এবং এতটাই সত্যের কাছাকাছি যে পিঠচুলকোনিতে ব্যস্ত বাংলা কবিতার পক্ষে তাকে হজম করা সহজ নয়। কেউ বলবে বিধ্বংসী উপাদান তো কেউ বলবে উদ্ভট রসায়ন। অথচ কোনো স্থির নির্দিষ্ট ডেমোগ্রাফিক ভার্সনের প্যাকেজে মুড়ে ফেলা যাচ্ছেনা তাঁর কবিতাকে । বাক্যে বাক্যে ঠান্ডা সন্ত্রাসের মত সেঁটে থাকা হাইফেনেটেড আইডেনটিটিজগুলো split narrative এর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে পাঠককে। এবং এখানেই দীপংকর দার কবিতার স্থায়ী ঘর বলে কিছু নেই, তাঁর শব্দদের যত্নআত্তি লালন টিকে থাকা ব্যাপারগুলোই আগাগোড়া সংঘাত বই কিছুই না। কবিতার ঘর খুঁজতে খুঁজতে কবিতার ঘর ছেড়ে চলে আসছেন যেন, আর ঘর নামের এই ফিকটিভ আইল্যান্ড থেকে বেরোতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত সমাজের লিমিনাল অ্যাম্বিয়েন্সটা তাঁর কবিতায় ভীষনভাবে প্রতিফলিত।

“আমি শুধু চাইছিলাম ক্রেন ও ড্রেজারগুলো ইউজফুল হোক   
যেহুতু টানা জল বা স্থল কিছুই ভালো লাগেনা
একটা টপসিডারভি হয়ে জল মাটি ড্রেজারে ঝুলে ঝুলে পাচার হয়ে হয়ে
পৃথিবী খানিক জল খানিক ঢিপলি আইল্যান্ড এভাবে
খন্ডিত জ্যাবড়া জ্যাবড়া হয়ে যাক
তাহলে কি দাঁড়ালো যতক্ষণ না আমার জাহাজ আসে
আমাকে এই জ্বর গায়ে বেশ্যার ভিড়ে
বেশ্যার ক্ষুদে বাচ্চারা
আংকল মাম্মি বুলারাহি হ্যায়
আংকল মেরি মাম্মি বুলারাহি হ্যায়
দাঁড়া জল দে অ্যাভোমিন গিলেনি একটা
চাকুর মরচে দুই কশ বেয়ে
জলে ফ্লাড লাইট হুল্লোর হুইশল ওঠে
প্রতিটা করিডরে ঘাতক
রাত্রির ডিফথং-এ মায়েদের বল
এই শেষ গ্রহ
পায়ে পায়ে জাহাজ আমার জাহাজ
আমার জাহাজ এলোরে
হো হো জাহাজ আসছে
আমার জাহাজ আসছে
হুররা জাহাজ আসছে – “

এবং এই ‘আনহোমলিনেস’ কোথাও যেন ‘মিথ অফ হোম’ এর শনাক্তিতে নাজেহাল করে তোলে আমাদের। কিন্তু কি এই ঘর? ডায়াস্পোরিক লিটেরেচারে তো ঘর নামের স্থবিরতার রুট ক্যানেল দিয়ে প্রতিনিয়ত নিঃশব্দে ঢুকে পড়ছে স্বপ্নভঙ্গের রুহ ও রাখ। দেখুন ওপরের কবিতায় কিন্তু ‘জাহাজ’ আসেনি, আসবে আসবে করছে,কিন্তু একটা কন্সট্যান্ট নয়েজ শুনতে পাচ্ছেন? দীপংকর দা তো চলে গেছেন লৌকিক ধারা থেকে অথচ সেই শব্দের ছায়া কি এখনও লেগে নেই পিছন থেকে ! প্রোটাগনিস্ট আসলে আপনি , আসলে আমি, আমাদের এগজিস্টেনশিয়াল রিয়েলিটিকে কখন যেন তাঁর ডায়াস্পোরিক হিউম্যানিস্টিক পোটেনশিয়ালে মিলিয়ে মিশিয়ে নিয়েছেন দীপংকর দা, এই সেই কবিতা যেখানে কবিতা নয় বরং শব্দ মধ্যবর্তী অস্ফুট চন্দ্রবিন্দুর মধ্যে আপনি আত্মিক যোগসূত্র পেতে পারেন। জানি আপনি কবিতা বুঝবেননা, বোঝার চেষ্টা করবেন এবং না বুঝতে পেরে দেগে দেবেন অ্যাবসার্ডিটি ফ্যান্টাসি ক্রিয়াহীন সাহিত্য রূপের কিছু একটায় , কিন্তু জ্যাবড়া জ্যাবড়া অথবা জাহাজ শব্দ দুটো আপনি বুঝবেন। আমি নিশ্চিত। কারণ এগুলো সেই কালেক্টিভ ম্যাট্রিক্স যা আপনাকে আপনার সাথেই ছদ্মযুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছে। আপনি কবিতার মধ্যে ছিলেন না অথচ আপনাকে টেনে এনেছে কবিতার মধ্যে। আসলে এই ন্যারেটিভ অফ রিসেটেলমেন্টেই তো ব্যক্তি নামের প্রহেলিকাকে প্রিজার্ভ করা হচ্ছে, দেশ কাল সময় নামের এই যে দর্শনের দ্বারা ভাষার দ্বারা এত বৈধ রিয়েলকে আমরা ঘোষনা করছি মহাআখ্যান পরাআখ্যান নাম দিচ্ছি তা তো আসলে এক সম্ভবানাতত্ত্ব যার ভেতর কেবলই কেওস কেবলই অস্থিতি। তাঁর ডায়াস্পোরিক চিন্তনে এই ফ্যাক্ট্রাল জিওমেট্রিই মানবজমিনের একমাত্র তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক মিথস্ক্রিয়া। দীপংকর দত্ত যে কবিতা লিখে গেলেন , রেখে গেলেন তা আসলে প্রথমত এবং শেষমেশ সমাজদৃষ্ট, মানুষের থিসরাস ঘেঁটে তুলে আনা,ফলে মুর্হুমূর্হু কল্পনা সেখানে পুঁটিমাছ হয়ে খিল্লি করেছে বেঁচে থাকার প্রতিটা প্রান্তদোষকে। কি নেই সেখানে ! মিথ,মেমোরি ,ইমাজিনেশন ,সমাজ , জীবনচক্রের গভীর জটিল ফিউশন ও ফ্যাগমেন্ট থেকে যে ডায়াস্পোরিক কাঠামোটা গড়ে উঠছে তাঁর কবিতায় সেখানেই শেষমেশ কোথাও যেন কেবল একটা অসমাপ্ততা। একদিকে হোম রিটার্নিং অন্যদিকে নাথিংনেস যদি এভাবে একটা ছবি ভাবা যায় দেখা যাবে এর মধ্যে প্রায় আমরা সবাই- হোমোজিনিটি হেটেরোজিনিটি ইমানেন্স ট্রান্সসেনন্ডেন্স নিয়ে মেতে আছি অলীক এক সেলিব্রেশনে অথচ দেখতেই পাইনি। আসলে আমাদের সবার মধ্যে যে একটা কবি এসে বসে ছিল চোখে ঠুলি পড়ে। দীপংকর দত্ত এসে সেই চোখেই ‘অ্যাসেটিক অ্যাসিড স্প্রে করলেন,লিনিয়ার এরিয়াগুলো রয়াল ব্লু  দাগ দিয়ে দিতে দিতে বললেন এবার এরা পজিটিভ এবার এদের স্ন্যাপ নিও’। ডায়াস্পোরিজম তাঁকে দিয়েছিল একটা কোয়েস্ট, ঠিক যেমন কবিতা তাঁকে দিল একটা ড্রাইভ, কিছু প্রশ্ন এবং কিছু প্রত্যাখান। তাঁর জীবনের যাবতীয়ই যেন তাঁর কবিতা এবং এর বাইরে আর কোনো কারবারী ফরমুলা নেই।

পোস্টমর্ডান ব্যাপারটা তো আজ আর পুরোনো কিছু নয়,অথচ এই ব্যাপারটাই দীপংকর দত্তর কবিতায় এসে নতুন গবেষণার দাবী রাখে। যেকোনো শিল্প কেন কেবল একটা কেন্দ্রে আবদ্ধ থাকবে,কেন সে কনটিন্যুইটি নামের একটি পরিসরের পুঁজি বাড়িয়ে তুলতে চাইবেনা এই তো ছিল পোস্টমর্ডানের দাবী এবং সেই প্রেক্ষিতে দেখলে কেবল পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা কেন সার্বিক বাংলায় কবিতায় এত প্লুরালিস্ট এপ্রোচ সম্ভবত দীপংকর দত্তের সমকালীন এবং তৎপরবর্তী কোনো কবির মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়না। কোনো লিটেরারি কসমোপলিটানিজমে বসে এই ডায়াস্পোরিক শিফটটা হাসিল করতে চাননি দীপংকর দত্ত । হাসিল করা যায় না। প্রকৃতঅর্থে রিফিউজি না হলে কবিতায় এমন কালচারাল রিপজিশনিং কার্ণিভালের রূপ নিতে পারত না। তথাকথিত পোস্টমর্ডানিস্ট কবিদের মত পোস্টমর্ডান আকরকে জড়িয়ে ধরে অধুনান্তিক কবিতা লিখতে চাননি দীপংকর দত্ত বরং অভিজ্ঞতাটাই তাঁর শেকড় , পরিপ্রেক্ষিত এবং প্রত্যয়। সেখানে নিবের ডগায় হাতেকলমে শেখার এক ক্লাস ফলে অন্যান্য অনেকের চেয়ে তাঁর কবিতায় নিহিত অন্বেষন অনেক বেশি আমিশ , উদোম। মালটিকালচারাল ফ্লাক্সের মধ্যে এই যে আইডেনটিটি ইমপ্রিজন্ড এটা তো সার্বিক, যার গায়ে ক্রমবদ্ধ বিশ্বমানুষের গন্ধ লাগা, এবং বাংলাভাষায় ঠিক এমন কবিতারই বড় অভাব, লেখা হয়নি এমন শব্দবন্ধ যা সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারে, যার গুঞ্জন ও হাসি-লুঠমার- ও থাপ্পড়ে লেগে থাকবে ইউনিভার্সাল সিগনালিং।  

দেখুন সংস্কৃতির সংজ্ঞাটা ঠিক কি? এবং সেটা যদি একজন কবিকে জিজ্ঞেস করা হয় দেখবেন তিনি আপনাকে একটা প্রিঅরগার্নাইজিং অঞ্চলের মানচিত্র খুলে দেখিয়ে দেবে, একটা মিনিয়েচর মডেল যেখানে সমান ইতিহাস সমান ভাষা সব কিছু যেন আপনার বোঝা এবং জানার রীতি অনুযায়ী নির্ধারিত। প্রথা কবিতার এই হল কমন ট্রেন্ড এমন কি কিছু পোস্টমর্ডান সাহিত্যবেত্তাকেও দেখেছি নির্দিষ্ট বন্ধনীর ভেতর জানাকে বেঁধে ফেলার এই খেলায় সামিল। অথচ দীপংকর দত্তের কবিতার কাছে এলে বোঝা যায় কেবল কম্যুনিকেশন, কবিতা নয় আপনি কেবল কম্যুনিকেশন দিতে পারেন এবং সংস্কৃতিও আসলে কিছু কম্যুনিকেশন ,অনেক কম্যুনিকেশন । মালটিপল আইডেনটিটিজ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষগুলো। এবং দীপংকর দা যেন সেই জাগলার যিনি প্লুরালিটি কুড়োতে বেড়িয়ে পড়েছেন।  তাঁর কবিতায় এই যে কালচারাল স্ট্রাটিফিকেশন তার জন্য অবশ্যই দায়ী বহুদিন যাবত তাঁর দিল্লীবাসী হওয়ার ব্যাপারটা। ফলে ডায়াস্পোরিক প্রতিস্বটি তাঁর কবিতার জলবায়ুর সাথে বেশ মানানসই হবে সেটাই স্বাভাবিক। মজ্জাগত সংস্কৃতির সাথে নতুন গৃহীত সংস্কৃতির ক্রশফার্টিলাইজেশন সেক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীপঙ্কর দত্তের পাঠবিশ্বে ঢুকে পড়লে এই অনুসন্দর্ভটি আমাদের এক অদ্ভুত অনির্ধারিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে যেখানে কবিতার নির্দিষ্ট গড়ন বা গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা না পেয়ে আমরা কেবল এক নিরবিচ্ছিন্ন গতির দ্বারা আক্রান্ত হই। বলা যেতে পারে আনপ্যারালেল মোবিলিটি, যা কবিতার মধ্যে দিয়ে আমাদের লিংগুয়িস্টিক বর্ডার ক্রশ করতে শেখায়। কি বলব তাঁকে? ইমিগ্রেন্ট! গ্লোবট্রটিং ট্রাভেলার! নাকি প্যাকেজ ট্যুরিস্ট? কবিতার মধ্যেও তো একটা গল্প থাকে , হোক না সে কল্পনার , চেতনার , আবার ডিসকোর্সও থাকে একটা। আর এই দুইয়ের মাঝে যে ইন্ট্রাটেক্সুয়াল মাইগ্রেটারি ওয়ার্ল্ড সেখানে দেখুন এক শব্দ থেকে অন্য শব্দের ক্লাস কাস্ট জেন্ডার মেন্টালিটির কি অনন্ত যুদ্ধ কি অবিরত ধ্বস্তাধ্বস্তি। প্রতিটি মূর্হুতে সেখানে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা,কিংবা বলা যেতে পারে সেটাই তাঁর কবিতাশৈলির অনুশীলন। দিল্লী গাজিয়াবাদ কালিন্দীকুঞ্জ হিন্দনের মত উত্তরভারতীয় হরিয়ানভি দোসুতি ভাষার বিস্তৃর্ণ কুয়াশাডাবিং উঠে এসেছে তাঁর কাব্যিক ভ্যালীপথে এবং যথারীতি একটা কোহোরার মোড়কে ঢেকে দিয়েছে বাংলা কবিতার একরৈখিক ভিসেরাকে।  ‘জিরো আওয়ার’ থেকে ( অরূপ চৌধুরী, গৌতম দাশগুপ্ত,রবীন্দ্র গুহর যৌথতায়) সংকলিত ‘পোস্টমর্ডান ব্রুহাহা’র বিজ্ঞাপনে দীপঙ্কর দত্ত পোস্টমর্ডান টেক্সটের যে তালিকা দিয়েছিলেন তাতে হাইপার রিয়ালিটি, রিজেকশন অফ বাইনারিজ, হাইপারটেক্সটের মত একাধিক পোস্টর্মডান চিহ্নকের সাথে হাইব্রিডাইজেশন যে থাকবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক ,কারণ পোস্টমর্ডান গ্রাফিত্তির যৌথতায় তা এক সক্রিয় অনুপূরক । কিন্তু দীপংকর দত্তের কবিতার প্রসঙ্গ এলে হাইব্রিডাইজেশন আমাদের একটি প্রকার থেকে প্রকল্পনার তন্ত্রে নিয়ে চলে। তুমুল হাইব্রিডিটি কেওসের মধ্যে দিয়ে দেখা যাবে কেবলমাত্র কবি দীপঙ্কর দত্ত নাম্নী এক মানুষের অভিবাসন নয় বরং সাথে সাথে ভাষার সার্বিক মাইগ্রেশনের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। তাঁর শেষ বই ‘বেইলবর্ণ বিষহরি’র একটা কবিতা থেকে আরও একটু স্পষ্ট হওয়ার চেষ্টা করি-

“ ক্ষুন্নিবৃত্তির পর পেঁচার চোখ বুঁজে এলে চাঁদ ওঠে
জ্যোৎস্নার জিগর টুকরার অটপসির পর সূঁচের কারু ফোঁড়াই
ফলস সিলছে ঝিঁঝিদের মিমিক্রি দিঘীপাড়   
একটি শরীরী প্রেম যায় আরেকটি আসে মাঝখানে আমরা যে
সাইবার গান্ধর্ব বিয়েটা করি আর কিল্লি বরাদ্দের অনলাইন ছা-পো হয়,
মন্টেসরি থেকে গার্জিয়ান কল এলে আমি বলি তুমি যাও, ও বলে রান্ডোয়া তুই যা,
তুই না বাপ, ডরপোক !
অতঃপর কাদার ক্কাথ থেকে বাকী ইঁদুরেরা বেরোয়
টেবলের লোনা পার্মেজান চীজ-ব্লক কুরেত কুরেত অ্যাকোয়ার ধনুষ ছুঁয়ে
লেফট হ্যান্ড মেরিন ডাইভ
সুরা সুন্দরীর শুয়ো, উন্নিস কা ন্যাগিং মেহেরউন্নিসা আর আমি বাতাস উনহনচাশ
ব্রাহুক ডাকছে   মাদল    বল্লরীর ধামসা ধামসা হেল্পডেস্ক
অত্রকৃত্যে বারবেলানুরোধে নিরবকাশে ন বহু সম্মতেঃ - ……”    

দেখুন একই বাক্যে মন্টেসরি –গার্জিয়ান কল-রান্ডোয়া কিংবা সুরা সুন্দরীর পাশে গালে গাল ঠেকিয়ে বসে থাকা ন্যাগিং মেহেরউন্নিসা শব্দবন্ধগুলোকে। অটোপসির আগে জ্যোৎস্না এবং অটোপসির পরে কারু ফোঁড়াইয়ের ভিসুয়াল লিটেরেচারগুলোকে। কিংবা সার্বিক কবিতার শৈলী ও প্রবর্তনার দিকে দিয়ে একেবারে তিনশ ষাট ডিগ্রী ঘুরে যাওয়া শেষ শব্দের নির্ঘন্টীয় ন্যারেটিভটিকে। জানি আপনি সরাসরি হয়ত বলে দেবেন এ তো কেবল ডিস্ট্রার্ব হাইব্রিডি। আমি বলব , না, এখানে সেলিব্রিটি ভয়েস থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে কালচারাল আপরুটিং এ মানুষ খুঁজছেন দীপংকর, সত্ত্বা খুঁজছেন কিংবা মিথের কাঠামো চিড়ে শেকড়ে ফেরার গল্প খুঁজছেন। কিংবা একটা জীবন কিংবা একটা প্রতিগল্প। এবং এটাই সেই এক্সপ্যান্ডেড লিটেরেচার যা প্রথাকবিতার বিস্ময়ের জাগরূক না হয়ে যোগাযোগের বাহন হয়ে বিরাট স্বরূপকে আইডেনটিফাই করছে। এবং সৃষ্টিকে অতিক্রম করে না বরং কেবল সৃষ্টিকেই তাঁর যাবৎসৃষ্ট ভাষায় বাঁধতে চেয়েছিলেন দীপংকর দত্ত। কোনো উড়োখই নয় বরং এতোটাই ডেন্সড অব্জেক্ট এই গুচ্ছ গুচ্ছ নতুন শব্দ সংকর শব্দ যা বাংলা কবিতার বিগত কয়েক দশকের রেস্ট্রিক্টিভ ফিক্সিটি থেকে আমাদের বের করে আনে। “কাঁঠালপাতা’ নামের আর একটা কবিতার কয়েক পংক্তির কবলে পড়ে গেলে বোঝা যাবে বাংলা কবিতার সোনার পাথরবাটিখান ঠিক কিভাবে চূর্ণ করলেন তিনি। - “ ডালপালার ছন্নি সিঁধ মেরে জোছন এখানে দখনে রায় ডোরা দাগরা হার্পিস/ আউশময় কাত্তিকী হীম আর হাওয়ার হুলু বোঁটকা কাইনানায়/……জোড়া পিঁড়ে পা-পা আলতার নিক্কণ এগুচ্ছে কপালিনী/ গোঁজ ক্যাথিটার বিছে পৈঁছা লটকা মুতথলি/মিনসা কালসাপ বলিহারি চক্কর কুলোপানা”- এভাবে শব্দকে নিয়ে কে এত গোঁয়ার হয়েছে? পুনবির্ন্যাসের আকুতিতে শান্ত শব্দের খুলিতে এভাবে গুলি ভরে দিয়েছে কে কবে? কিন্তু আমি একে পাওয়ার পোয়েট্রি বলতে চাইনা, স্ল্যাং সেলিব্রেশনও বলতে চাইনা। বরং এ সেই পোয়েট্রি অফ ডিসপ্লেসমেন্ট। অনাশ্রিত ব্রাত্য প্রতিশব্দরা এভাবে শব্দের গায়ে গা দিয়ে রেসিয়াল মাইনরিটি হয়ে উঠে আসার মধ্যে দিয়ে একটা জিনিস জলের মত স্পষ্ট হয়ে যায় মনোলজিকাল এবং স্ট্যাটিক পার্স্পেক্টিভ থেকে কবিতাকে দেখতে চাননি তিনি। ফলে তাঁর কবিতার কোনো চেতনাকেন্দ্র খুঁজে ফেরা নিরর্থক কারণ চেতনা দিয়ে কবিতা স্ট্রাকচারাইজড করা হলেও কেবলমাত্র চেতনার জোব্বায় তাকে জড়িয়ে নেননি তিনি বরং তার চার দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন অজস্র ফোঁকর ,সেখান দিয়ে চলমান অভিজ্ঞতারা আসছে যাচ্ছে, অফুরান শব্দভাণ্ডার ধরে ধরে একজন পাঠক ডিসকন্টিন্যুইটিতে প্রবেশ করতে পারছে এবং সেটাই তো মেজর ল্যাংগুয়েজ যা অমরত্বের দাবী ছেড়ে অক্ষরের মুখ খুলে দিচ্ছে অস্তিত্বের দিকে; ব্যক্তি মানুষ এবং কবিতার মধ্যে যে দীর্ঘ আড্ডা যে ছেদ বিচ্ছেদের ধারনা তা একজন কবি যখন সংকেতে খুঁজে ফেরেন তখন বলতে হবে তিনি কোনভাবেই ‘ক্লোজড অফ ল্যাংগুয়েজ ইউনিভার্সের’ পড়শী নন বরং মেটাফরের মধ্যে দিয়েও তিনি আদতে মেটানমি থেকে বেরোতে চাইছেন , সমষ্টিজগতের দ্বন্ধের ইচ্ছাকৃত শরিক হতে চাইছেন।

গবেষক প্রাবন্ধিক সুকুমারী ভট্টাচার্যের কিছু কথা এ মূহূর্তে মনে পড়ছে- ‘ সাহিত্য অমল তরু নয়। সামাজিক রাষ্ট্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকেই উদ্ভুত বলেই এগুলির প্রতিবিম্ব সাহিত্যে দেখা যায়। কবিমানসের মাধ্যমে সর্জনী শক্তির রসায়নে বাস্তবের রূপায়ণ ঘটে বলেই সামাজিক ইত্যাদি অবস্থা সরাসরি প্রতিফলিত হয় না সাহিত্যে। কিন্তু এগুলির প্রভাব অনস্বীকার্য”- দীপংকর দার কবিতার কে কেমন ব্যাখা করবে তা জানিনা কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে মনে হয়েছে তাঁর কবিতায় প্রতিসরণের জায়গা যতখানি তার চেয়ে প্রতিফলনের জগতটা অনেক বেশি। বিশুদ্ধ ফাঁকার মধ্যে কবিতাকে কখনই তিনি পেতে চাননি। তাঁর কবিতায় কল্পনার যতটা না জায়গা তার চেয়ে ঢের বেশি অরগ্যানিক হাইব্রিডিটির। এবং এর ফলে কোনো বহিরাগতের চোখ দিয়ে দেখা নয় তাঁর কবিতা ঠিক যেটা দশকের পর দশক বাংলা কবিতায় হয়ে এসেছে , হয়ে আসছে, কবিতা যেখানে সুবন্ধুসুলভ একটি প্রবর্তনা মাত্র , কিংবা একটি শব্দকৌশল, যেন আশ্চর্যভাবে ঘটে যাওয়া কিছু। আসলে পোস্টমর্ডান ক্যাননে ফেললেও বাঁধাধরা গতে তাঁর কবিতাকে বেঁধে ফেলা মুশকিল, এবং তারও একটি কারণ অবশ্যই তাঁর পকেটে খুচরোর মত থেকে যাওয়া সীমাহীন শব্দভাণ্ডার।যেকোনো নতুন কবির কাছে যা শিক্ষনীয় ,যেকোনো পুরাতন কবির কাছে যা রীতিমত ঈর্ষার। সারাজীবনে যে কটা কবিতা লিখেছেন যে কটা নতুন কবিতা আমাকে মেল করে পড়িয়েছেন আমি অন্তত দেখিনি এক শব্দ অন্য শব্দের এলাকা দখল করেছে। কখনও কখনও তাঁর কবিতাকে আমার কবিতা না বলে ল্যাংগুয়েজ গেম বলতেও ইচ্ছে করত, আর এবিষয়ে দীপংকর দাকে মেল করলেই উত্তর পেতাম ‘কবিতার প্রিসাপোজড গ্রাউন্ডকে আমি মানিনা, মানিনি, কোনো ভিত্তিপ্রস্তর, কোনো মেনে নেওয়া ফাউন্ডেশন কবিতাতন্ত্রের বিরোধী’। ফলে দীপংকর দত্তের সার্বিক কবিতাভূবনটাই কোথাও কথার বাইরে কল্পনার বাইরে এক আশ্চর্য কম্যুনিকেশনের ভূবন। যেখানে শব্দকেই সন্দেহ করা হয়েছে প্রত্যহ এবং শব্দের পাশে শব্দকে যোগ করার বাস্তবতা বোধ করেছেন নিয়ত। সন্দেহ করেছেন তথাকথিত স্থান-কাল-পাত্রের সিন্ডিকেটকে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হল একটি তৃতীয় স্পেস তৈরী হওয়া। যেখানে কবিতার বুলিতে ট্রান্সলেশন লোন বা ঋণজাত শব্দের সরল তরল ব্যাখার বাইরে ট্রান্সভ্যালুয়িং আমাদের ভীষনভাবে ভাবায়। বঙ্গভাষার বেশিরভাগ পোস্টমর্ডান হাইব্রিডিটির মত কেবল মাত্র শব্দ  এনে শব্দের মুখে বসিয়ে দেওয়া বা নিওলগিজমের মত কেবল নতুন শব্দ তৈরি নয় , বরং শব্দের অনুসন্ধানে বেরিয়ে কখন একজন স্রষ্টা কিভাবে কখন সার্বিক একটি সংস্কৃতির সাথে আশ্লিষ্ট হয়ে যান তারই আকর দীপংকর দত্তের কবিতা। এই আকরকে আমি বিরোধাভাসের আকর বলব কারণ একটা ব্যাপক পাঠক্রিয়ার শেষেও আমরা সম্পূর্ণ আদল খুঁজে পাইনা এবং অনিশ্চিয়তা বাড়ে। আসলে পোস্টমর্ডান পরিসরে হাইব্রিডাইজেশনকে কেবল শব্দের চারদিকে ঘোঁট পাকাতে দেননি দীপংকর দা বরং তাকে একধরনের evocative term for the formation of identities হিসেবেই মান্যতা দিয়ে এসেছেন বরাবর। ‘ডুগডুগি’ কবিতায় তিনি যখন লেখেন – “ ছালাম আমার লাঙ্গুরডারে দ্যাখছেন মিএজ্ঞা? জিগরটুকরার এই চাঁদ মাথারীর আলোয়াল ছাদনার ভর পড়েছে রদ্দি তস্য রদ্দি খন্ডহরের হিটকি পলেস্তায়। গাঁড় ওলটানো বাদুর নহেলপে নেউল আর সাপের দাঙ্গা দহেলা। বিপরীত প্যাঁচ খুলতে খুলতে রডে ঘড়িরীত পেঁচিয়ে উঠছে দোমুহার মুখোট আর আয়ানের  আম্মি ও চুদক্কর ফুফাজানের ভিগি বেডকাপড়। কো নহী জানৎ শরপে ফেট্টি মলমলকা তাহে মুর্গাফুল থোৎনায় মিট্টির চকাচ্চক পমেটম কুমার দিলীপ তিহারো নাম বাপু কই গেলা আবো রে কদরদানের ভিড় যে খামতি নেগেচে-“ –বোঝা যায় তাঁর চিত্রায়নে এতটাই সৎ থেকেছেন যে সমগ্র অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে গেছেন ট্রান্সন্যাশানাল কালচারের মধ্যে দিয়ে এবং ন্যারেটিভে এই ক্রশফার্টিলাইজেশন মানূষের একটি সার্বিক মনতাজ রূপে কাজ করে গেছে।  কি প্রবল স্থানীয় ভাষার প্রভাব ও প্রতিবিম্বন এবং ক্রশ কালচার এই এনকাউন্টারে বাংলা ভাষার বায়োলজিকাল ডোমেইনকে তছনছ করে তুলে এনেছেন একটি ক্রিটিকাল কম্যুনিকেশন যাকে প্রাথমিক ভাবে একধরনের ফরেন ডিসকোর্স মনে হলেও মেনস্ট্রীম সাহিত্য বা একাডেমিক ডিসিপ্লিনের বাইরে এই স্থানিক নির্মিতি পক্ষান্তরে কালচারাল লজিক অফ গ্লোবালাইজেশনকে মান্যতা দিয়ে যায়। ফলে তাঁর কবিতায় কালচারাল পলিটিকাল ও লিংগুইস্টিক এমন মালটিপল ট্রাকিং থেকে হাইব্রিডাইজেশনকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। । এবং কাব্যদর্শনটিকে চেতনার চেয়ে অনেক বেশি পরিমানে কালচারাল ইন্ড্রাস্টি প্রোডাক্ট হিসেবে ধার্য করা যেতে পারে।

একটা সময় ছিল যখন মানুষ ভাবত শব্দের মধ্যে দিয়ে কি ভাবে কথা বলা যায়। তারপর সময় এল শব্দের মধ্যে দিয়ে ছবি কিভাবে আঁকা যায়; এবং তারওপর ভাবনাচিন্তা এল শব্দের মধ্যে দিয়ে ছবি এঁকে কতদূর যাওয়া যায় ! বাংলা কবিতা অলিগলি রাজপথ পেরিয়ে দুর্নিরীক্ষ্য এক দূরের ; নিরাসক্ত বোধিও যেমন চাননি তেমন শূন্যে ঘুঁষি ছোঁড়ার পক্ষপাতী ছিলেন না বরং  ট্রান্সরিজিওনাল নিগোশিয়েসনের ভেতর দিয়ে বাংলাসাহিত্যের মূল লঘুকথনের চোখ উপড়ে নিয়েছে দীপঙ্কর দত্তের কবিতা । একটা সময় ছিল যখন বাংলা কবিতায় ইউটোপিক পরিসরের রমরমা। কবিতা সেখানে সুষ্ঠ,বিশুদ্ধ, সহনীয় ও ‘প্রকৃত’। উত্তর আধুনিক পরিসরে ক্রমাগত এই ইউটোপিক মোল্লাতন্ত্রের ভেতর গোপণ আগ্রাসন শুরু করল ডিসটোপিক উচ্ছিষ্টজীবীর দল। যাদের কাছে প্রথম কাজটিই ছিল স্বপ্ন নামের ছেলেটিকে ধাক্কা দেওয়া এবং কল্পনা নামের মেয়েটির স্বরূপকে অস্পষ্ট প্রমাণ করা। কিন্তু যতই পোস্টমর্ডানপরিসরের পাঁচন ঘাঁটবেন দেখবেন মর্ডানিজমের লিনিয়ার গতিকে বা কেন্দ্র প্রান্ত ক্রমকে কিংবা টোটালিজমকে নস্যাৎ করতে যে অধুনান্তিক নির্যাস ছড়িয়ে দেওয়া হল তা ঘাঁটলে লক্ষ্য করা যাবে প্রথার অচলায়তন ভাঙ্গতে প্রতিবাদের সহজপাঠ তো ছিল কিন্তু ধ্বংস ছিলনা। আসলে আপনি যখন কবিতাকে অংশত সত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইবেন তখন ধরে নিতে হবে আপনি আসলে কবিতাকে সার্বিক মিথ্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন।এবং এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার চিন্তাক্রিয়ায় হয় কিছুটা বেশি আছে অথবা কিছু না কিছু একটা নেই।ফলে আপনি দেখতে পাচ্ছেন তাকে হাজার হাজার দিক দিয়ে অথচ খুঁজে পাচ্ছেন না তাকে। পাশাপাশি দীপংকর  দত্ত বলছেন-“ওসব মায়া ফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার দ্রুত ভেঙে ফেলতে হবে”- অর্থাৎ শব্দকেন্দ্রিক স্মৃতি আর স্থবিরতার শ্রেষ্ঠত্বের মিথকে ভেঙে মিশেল দিলেন অনুঘটনার,আকস্মিকতার। তিনি হরফের আকার বদলাননি, কেবল তাঁর ভেতর পুরে দিয়েছেন জিলেটিন জিয়নস্টিক টলটলে ধ্বংস।  হ্যাঁ ধ্বংস! দীপঙ্কর দা বলত ভাষা দিয়ে ভাষার নিধনযজ্ঞ। আর আমি বলি এ আসলে একধরনের স্বতন্ত্র রঙের অন্ধকার উৎসব। মাঝে মাঝে মনে হত তিনি কি সারভাইভালিস্ট? যাবতীয় ধস্তাধ্বস্তির পর প্রান্তভাষ্যের সাথে মূলভাষ্যের সমস্ত প্রচল কাব্যিক ডগমাকে গুলিয়ে দিয়েছেন যে। যেন তাঁর নিজস্ব ডায়াস্পোরিক আইডেনটিটিজই প্রত্যহ নিজের কাছেই হাইফেনেটেড আইডেনটেটিজ়ের এজলাজ বসিয়েছে। খাদ্যচক্রের শীর্ষে থাকা মানুষের মতই কবিতার শীর্ষে থাকা নির্জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞান সংশ্লিষ্ট একব্যক্তিক এসথেটিজমের বাইরে বেরিয়ে এসে আন্তর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠাকে আমার মনে হয় একেবারে তাঁর নিজস্ব আইডিওলজিকাল ভায়োলেন্স। এ যেন সেই ‘চিড় খাওয়া জল মূহূর্তে জুড়ে যায় ফের’ –তবু’ শুধু কোপানো ,খাবলানো পিঠ, পাছা ও পাঁজরগুলি হাঁ হয়ে থাকে’- শব্দের এমন জায়মান বীজ নিয়েই তো দীপংকরের নিউর্যালজিয়া। তাঁর কবিতা নিয়ে বহুকাল আগে রবীন্দ্র গুহ বলছেন- “ যুক্তিবিরোধী, প্রথাবিরোধী,তত্ত্ববিরোধী পাওয়ার পোয়েট্রি। যা একান্তভাবেই দীপংকরের বাকবদ্ধ জীবনপাঠ”। ধরা যাক শুধু ওই ‘বাকবদ্ধ জীবনপাঠ’ শব্দবন্ধটুকুই আজ আমরা প্রবন্ধের শিরোনাম করলাম এবং বাকি অংশটুকুকে প্রতিস্থাপিত করে দিলাম কিছু ইনভারট্রেড রিয়েলিটি দিয়ে।

দীপঙ্কর দত্ত নেই। দীপঙ্কর দত্ত ছিলেন। দুটোই যেমন সত্যি ঠিক তেমনি সত্যি এ কথাটা ভাবার সময় এসেছে দীপঙ্কর দত্তর কবিতা আমাদের জন্য কি রেখে গেল!কবিতার মধ্যে দিয়ে ইদানীং বেঁচে থাকাটা খুব একটা ভাল লাগছিলনা, অহংকারী সাহিত্যের অপাহিজ গর্দনে বসে আর কতদিনই বা নিজেকে খুঁজব । একেবারে শেষের দিকের কিছু ব্যক্তিগত মেলে এমনটাই ছিল দীপংকর দার আক্ষেপ । এখনও মেল খুললে জ্বলজ্বল করছে ১০/২১/১৬ র মেল, যেখানে ‘বেইলবর্ণ বিষহরি’র কভার অ্যাটাচ করে দীপংকর দা লিখে গেছে- “হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ বই।পৃথিবীর বোঝা হয়ে বেশিদিন বাঁচার কোনো দরকার নেই।   “- অথচ পোস্টমর্ডানিস্টরা নেমে পড়েছিলেন যে ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’এ সেখানেই তাঁর যুক্তিতর্ক ছিল আরও কিছুটা যাওয়ার । প্রত্যহ শিল্পের নির্দিষ্ট কোনো এথনিক এনক্লেভ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইত দীপঙ্করদা। বেঁচে থাকতে চেষ্টা করতেন আরও কিছূটা । হয়ত ‘ফুসফুসের দুর্গন্ধ ধাঙর’দের লুকিয়ে, হয়ত ‘রিহ্যাবের খোয়া ও মোরাম’ সাজিয়ে কিন্তু যেভাবেই হোক বাংলা কবিতার নিরোম সংজ্ঞা পেরিয়ে ‘ঘিনোনা” এক নতুনের দিকেই তুলে রাখা থাকত তাঁর হো হল্লা তাঁর হ্যাণ্ডকাফ।
কেবল আমাদের সময় হয়নি তাঁর জীবতকালে এটুকু শোনার, বাংলা কবিতার আপেলসবুজ নম্র দেবায়তনের দিকে অন্তত কেউ একজন একনাগাড়ে বলে চলেছে –" ফাক্মি ফাক্মি ফাক্মি ফাক্মি ফাক্মি ফাক্মি ডার্লিং ফাক মি –"

2 comments:

  1. "বোঝা যায় তাঁর চিত্রায়নে এতটাই সৎ থেকেছেন যে সমগ্র অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে গেছেন ট্রান্সন্যাশানাল কালচারের মধ্যে দিয়ে এবং ন্যারেটিভে এই ক্রশফার্টিলাইজেশন মানূষের একটি সার্বিক মনতাজ রূপে কাজ করে গেছে। কি প্রবল স্থানীয় ভাষার প্রভাব ও প্রতিবিম্বন এবং ক্রশ কালচার এই এনকাউন্টারে বাংলা ভাষার বায়োলজিকাল ডোমেইনকে তছনছ করে তুলে এনেছেন একটি ক্রিটিকাল কম্যুনিকেশন যাকে প্রাথমিক ভাবে একধরনের ফরেন ডিসকোর্স মনে হলেও মেনস্ট্রীম সাহিত্য বা একাডেমিক ডিসিপ্লিনের বাইরে এই স্থানিক নির্মিতি পক্ষান্তরে কালচারাল লজিক অফ গ্লোবালাইজেশনকে মান্যতা দিয়ে যায়। ফলে তাঁর কবিতায় কালচারাল পলিটিকাল ও লিংগুইস্টিক এমন মালটিপল ট্রাকিং থেকে হাইব্রিডাইজেশনকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। । এবং কাব্যদর্শনটিকে চেতনার চেয়ে অনেক বেশি পরিমানে কালচারাল ইন্ড্রাস্টি প্রোডাক্ট হিসেবে ধার্য করা যেতে পারে।"....to the point exactly what he used to relate .your writing is very existential in thought.ভাল লাগলো বিশ্লেষণী ডেপথ । খুব টাচী লেখা । আর এটা খুব সত্য যেখানে ‘বেইলবর্ণ বিষহরি’র কভার অ্যাটাচ করে দীপংকর দা লিখে গেছে- “হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ বই।পৃথিবীর বোঝা হয়ে বেশিদিন বাঁচার কোনো দরকার নেই। উনি জানিয়েই গেছেন যে উনি আর থাকবেন না বেশিদিন । strong astrologer ছিলেন যে বোঝাই যায় ।

    ReplyDelete
  2. তোর লেখা পড়ে পুরো কেঁপে গেলাম রমিত।

    ReplyDelete

Facebook Comments