ঋক সৌরক

ব্রূহাহা

 ঋক সৌরক



দীপঙ্কর দত্ত র সাথে আমার পরিচয় শূন্যকালের থ্রু দিয়ে। তার কবিতার সাথে আলাপ তারও অনেক অনেক পরে। শূন্যকালে বিভিন্ন কবির কবিতার ইলাস্ট্রেশনে তিনি যে ছবিগুলি ব্যবহার করতেন তা আমাকে হতবাক করে দিত। মুখোমুখি আলাপ হবার আগে আমি ভেবেছিলাম দীপঙ্কর দত্ত একজন লম্বা-চওড়া কাউবয় টাইপ কেও। মাথায় লম্বা লম্বা চুল। মুখে-গালে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। প্রতিটার সাথে এক বা একাধিক গল্প জুড়ে আছে। সেইসব স্মৃতির নক্সা বহন করে বেড়াচ্ছে তার মুখ। যে লোকটার মুখে এত ক্ষতচিহ্ন থাকতে পারে, না জানি তার শরীরে ও মনে কত ক্ষত সুপ্ত আছে। আর এখানেই দীপঙ্কর দত্ত র রহস্য আমাকে হাতছানি দিত। মনে হত উনি একজন শিকারী, রেবেল...  একদিন হঠাত শিকারে বেরিয়ে দীর্ঘদিন বাড়ি ফেরেন না। অপেক্ষারত মানুষেরা অপেক্ষা করা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আর ঠিক সেইসময় এক নিশুতি হিমেল রাতে সে ফিরে আসে...সাথে  সহস্র শিকারের গল্প

আমাদের প্রথম দেখা হল কলকাতা বইমেলা ২০১৫. আমি নিরাশ হয়েছিলাম। আদ্যোপান্ত দোহারা চেহারার একজন মধ্যবিত্ত মানুষ। মাথায় নির্লিপ্ত টাক, পোশাক-আশাকেও অতি নির্লিপ্ততা। বুক পকেটে পেন আর কাঁধে কবিঝুলি... দীপঙ্কর দত্তকে আমার যাবতীয় ফ্যাণ্টাসির সেখানেই ইতি হবে ভেবেছিলাম... কিন্তু, মানুষ মরে যায়, ফ্যাণ্টাসি মরে না! শূন্যকালে দীপঙ্কর দত্তের ইলাস্ট্রেশন আমাকে খুন করত নিয়মিত। একজন  আগাগোড়া সামান্য চেহারার মানুষ কিভাবে নিজের মধ্যে এমন শিকারী পুষে রাখেন ভাবলে শিউরে উঠতাম, রোমাঞ্চিত হতাম। যে মানুষটাকে ভাগ্য-ভবিতব্যের তোয়াক্কা না করা একটা বোহেমিয়ান র‍্যাপসডি ভেবেছিলাম জানতে পারলাম সে নাকি শেয়ার বাজারের তিলক কাটা ব্রোকার এবং জ্যোতিষচর্চা তার হবি ও প্যাশন। আমাকে এই ছুপা রুস্তম দ্বৈতসত্তা অভিভূত করত। এ যেন ছলে-বলে-কৌশলে মন্ত্রপুত: কোনও শেকলে বেঁধে রাখা বন্য নরখাদক, যাকে এক মহাচতুর শিকারী এক আদিম যাদুবিদ্যায় চিরন্তন বশীভূত করেছে।

দীপঙ্কর দত্ত সেইসব শিকারীর একজন,যারা নিজেকেই শিকার করে অজস্রবার। আর এই অমায়িক মৈথুনের পারম্পর্যে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তথাকথিত লৌকিকতা থেকে,  বীতস্পৃহ হয়ে যান আয়োজনের গুরুগম্ভীর আওয়াজে, সৃষ্টির কলরোল থেকে যোজন দূরে নিজের পশুটার পরিচর্যা করে যান দিবারাত্র,  তার সাথে খেলেন, ঘুমান, খান আর মাঝে মাঝে শেকল খুলে দেন। 


অতিসুলভ পোয়েটিক লাইসেন্স পাওয়া কবিদের স্বভাবসিদ্ধ ভিড় তাই দীপঙ্কর দত্তকে গ্রাস করতে পারে না, ইনফ্যাক্ট ছুতেই পারে না। নিজেকে সহজাত অচ্ছুত বানিয়ে তিনি তাবু ফেলেন নিজের সন্ন্যাসে। টিপটপ কবিদের সাজানো গোছানো জগতে তাই তিনি এলিয়েন কবি। কবি তথা ভদ্রলোকেদের লোকদেখানো সংসার তার নয়। বাথরুম টা যেখানে হবার কথা কিম্বা বেডরুম টা যেখানে অথবা ডাইনিং - এসবের রুটম্যাপ রোজ যেন বদলে যায় দীপঙ্কর এর! সে কখনো বাথরুমে ঘুমিয়ে পড়ে, ডাইনিং এ হিসি করে ফ্যালে আবার বেডরুমে ট্রেকিং করে...এতটাই অগোছালো তার যাপন, যা আজকের সদাবাহার কাব্যললনায় ফোকাসিত কবিদের খুতখুতে করে তোলে। যে দীপঙ্কর বাস্তব চৌহদ্দিতে এতখানি সাদামাটা -একাকী-অগোছালো কবিতা তার কাছে সেই হারানো পথ যা কেবল নিরুদ্দেশে যায়।  নিজের পশুটার সাথে গ্র‍্যাভিটিতে ভবঘুরে সাঁতার কাটে। তার প্রচ্ছন্ন চেয়ে থাকাগুলি পাথুরে ভাবনার স্পর্শে হয়ে ওঠে প্রকট বিকৃত ইনফিডেল

আমরা তাই যারা অপেক্ষা করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়ছি, তাদের বলে রাখি, খবরদার, যেকোনও হিমেল নিশুতি রাতে আপনাদের কবিতার স্বপ্নে বা স্বপ্নের কবিতায় দরজা নক করতে পারে একটি ধূসর আওয়াজ "ব্রূহাহা"... খবরদার!

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments